এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান

*অবসরের পর দেয়া বিতর্কিত রায় থেকেই সংকটের শুরু
একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কিংবা একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা যদি তার অবসর গ্রহনের ১৬মাস পর চাকুরিকালীন সময়ে তারজন্য বরাদ্দকৃত অস্ত্রটি আবারো ব্যবহার করতে চান সেটি কি আইনগতভাবে বৈধ হবে? হবে না।
ঠিক তেমনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ১৯৮৮ সালের বিধি অনুযায়ী একজন বিচারককে রায় দিতে হবে প্রকাশ্য আদালতে। যার ফলে অবসরের পর রায় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সেই অপকর্মটিই করেছিলেন।

২০১১ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের আদেশের সময় প্রকাশ্য আদালতে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, পরবর্তী আরো দুইটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজন করা যেতে পারে। অথচ সেই রায়ের লিখিত আদেশ তিনি প্রদান করেন তার অবসর গ্রহনের ১৬ মাস ১সপ্তাহ পর। অত্যন্ত আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে- সেই লিখিত রায় লেখার সময় তিনি ইতিপূর্বে আদলতের রায়ে দেয়া তার আদেশ ‘পরবর্তী আরো দুইটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজন করা যেতে পারে’ অংশটি বাদ দেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য তিনি এই রায় লিখে বাংলাদেশের রাজনীতিকে চরম সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়ে ঐ দলটিকে নির্বাচনবিহীনভাবে দেশ পরিচালনার অবৈধ ও অগনতান্ত্রিক অসদুপায় অবলম্বনের পথ তৈরী করে দেন।
বিতর্কিত রায় আগেও দিয়েছেন

আদালতকে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহারের দৃষ্টান্ত এ বি এম খায়রুল হকের জন্য এটাই প্রথম নয়। এর আগেও তিনি এভাবে অপ্রাসঙ্গিক বিতর্কিত আদেশের মাধ্যমে আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন। শেখ মুজিবের আমলে ‘মুন সিনেমা’ হলকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে রাষ্টের মালিকানায় নেয়া হয়েছিল, যার ধারাবাহিকতা পরবর্তী সরকারগুলোর আমলেও বহাল ছিল। সেই সিনেমা হলের ক্ষতিগ্রস্থ মালিক ঐ সম্পত্তির মালিকানা ফিরে পাবার জন্য আদালতের দারস্থ হন।
সেই সিনেমা হলের মালিকানা ফিরে পাবার আর্জিতে বাদী কোন সরকারের আমলের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নাই। কিন্তু বিতর্কিত বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ঐ মামলার রায় প্রদানের সময় সম্পূর্ন অপ্রাসঙ্গিকভাবে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল ঘোষনা করেন এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলকে অবৈধ ঘোষনা করেন। সেটিই ছিল আদালতকে ব্যবহার করে অপরাজনীতির প্রথম দৃষ্টান্ত।

অথচ- সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা দেবার এবং বিচারপতিদের মর্যাদা ও চাকরীর মেয়াদ বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া ছিল সংসদের হাতে আর শেখ মুজিবের ৪র্থ সংশোধনীতে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রপতির (শেখ মুজিবের) হাতে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেই ক্ষমতা দেন বিচারকদের প্রতিষ্ঠান সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে। এর ফলে বিচারকরা রাস্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনার অধিকার পান। শেখ মুজিবের ৪র্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে শপথ গ্রহন করানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পার্লামেন্টের স্পিকারের কাছে। ৫ম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেই দায়িত্ব অপর্ন করেন প্রধান বিচারপতির কাছে। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ‘রাষ্ট্রপতি’কে প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণের সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ৫ম সংশোধনীতে অন্তর্ভূক্ত করে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিচারপতিদের সম্মানকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেন। এখানেই শেষ নয়; প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ৫ম সংশোধনীতে বিচারকদের অবসর গ্রহনের মেয়াদ বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের চাকরীর মেয়াদও বৃদ্ধি করেন।
গোস্ত হারাম কিন্তু ঝোল হালাল!

মুন হলের মালিকানা নিষ্পত্তির রায়ে বিতর্কিত বিচারক এ বি এম খায়রুল হক যখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামল এবং তাঁর দেয়া ৫ম সংশোধনী বাতিল করার রাজনৈতিক আদেশ প্রদান করেন, তখন তিনি তার ভাষায় ‘অবৈধ সরকার’ এর আমলে দেয়া বিচারপতিদের সম্মান ও সুবিধাগুলো কিন্তু রদ করেন নাই। তিনি কিন্তু বলেন নাই যে, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দেবার সিদ্ধান্তটি ‘অবৈধ’ ছিল; তিনি বলেন নাই যে, প্রধান বিচারপতির কাছে রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহনের সিদ্ধান্তটি ‘অবৈধ’ ছিল এবং সেই অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নেয়া পরবর্তী সকল রাষ্ট্রপতিরা ‘অবৈধ’ ছিল; তিনি একথাও বলেন নাই যে, তার ভাষায় ‘অবৈধ’ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে তার (খায়রুল হকের) রায়ে ‘অবৈধ’ ঘোষিত সংবিধানের ৫ম সংশোধনী অনুযায়ী বর্ধিত মেয়াদে চাকরী করা বিচারপতিদের দেয়া আদেশগুলো ‘অবৈধ’ ছিল, এমনকি বর্ধিত চাকরী মেয়াদে বিচারপতিদের নেয়া বেতন-ভাতা ‘অবৈধ’ ছিল।
এই বিতর্কিত বিচারপতি খায়রুল হক নিজেই তার একটি রায়ে উল্লেখ করেছিলেন, বিচারপতি’র পদ থেকে অবসর গ্রহনের পর কোন বিচারক তার পেনশন ও প্রাসঙ্গিক ভাতা বাদে আর কোন রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন না এবং রাষ্ট্রের কোন লাভজনক পদ গ্রহন করতে পারবেন না। কিন্তু নিজের সেই আদেশ নিজেই লঙ্ঘন করে তিনি অবসর গ্রহনের পর গরিব জনগণের জন্য সংরক্ষিত ত্রাণ তহবিলের কয়েক লক্ষ টাকায় বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন এবং রাষ্ট্রের লাভজনক ‘আইন কমিশনের চেয়ারম্যান’ পদ গ্রহণ করেছেন।

রাজনৈতিক সংকটের জন্য দায়ী খায়রুল হকের বিতর্কিত রায়
সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত। সেই সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ অবরুদ্ধ করে দিয়ে একটি স্বৈরাচারী সরকারকে অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য অবসর গ্রহণের ১৬ মাস ১সপ্তাহ পরে বিতর্কিত রায় দিয়ে বাংলাদেশের গনতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার হরণের কালো অধ্যায়ের পথ তৈরী করে দিয়েছিলেন এই খায়রুল হক। সেই সময় থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন, ভোটাধিকার এবং গনতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা কয়েক শত মানুষের গুম-খুনের জন্য দায়ী এই বিচারপতি খায়রুল হক।
আদলত অবমাননার বিচার হওয়া জরুরী

এখন খায়রুল হক তার সেই বিতর্কিত রায়ের বিষয়ে সংবিধানের ১৬’শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চের রায়ের সমালোচনা করছেন বেআইনী ভাষায়! সর্বোচ্চ আদালত থেকে দেয়া একটি রায়কে তিনি প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে ঐ রায় প্রদানকারী বিচারকদের ‘ইমম্যাচিউরড’ বলে কটাক্ষ করেছেন, রায়টির পর্যবেক্ষণসমূহকে ‘সঠিক নয়’ বলে ঘোষনা করেছেন, এই রায়কে ‘পূর্ব ধারণাপ্রসূত’ ঘোষণা করেছেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ‘বিচারকদের প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে কটাক্ষ করে আদালত এবং প্রজাতন্ত্রকে অপমান করেছেন।

খায়রুল হকের এই প্রতিটি কাজ ‘আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী সুষ্পষ্টভাবে আদালতের অবমাননা এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বাংলাদেশের আদলত এর আগে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানসহ অনেক ব্যক্তিকে এরচেয়েও তুচ্ছ কারণে আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তি প্রদান করেছে। এখন জনগণ দেখতে চায়, সর্বোচ্চ আদালত, তার রায় এবং বিচারপতিদের নিয়ে প্রকাশ্যে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা খায়রুল হককে আদালত অবমাননার জন্য শাস্তি দেয়া হয় কিনা।
উল্লেখ্য যে, এর আগেও আবুল মাল আব্দুল মুহিত উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের চরমভাবে অসম্মান করে বক্তব্য দিয়েছেন। তার দেখাদেখি ক্ষমতাসীন দলের আরো নেতারা আদালতকে অবমাননা করে বক্তব্য দিয়েছেন।

এইসব আদালত অবমাননার বিচার না হলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা পৌছাবে। জনগণের মধ্যে আদালতের সক্ষমতা ও শাস্তিপ্রদানে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরী হবে। জনগণ মেরুদণ্ডবিশিষ্ট বিচারক দেখতে চায়। আজ যদি এইসব আদালত অবমাননাকারীদের বিচারের সমূক্ষীণ না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আদালত অবমাননাকারীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। সেই সময় তাদের বিচার করতে গেলে আজকের বিচার না করাদের বিষয়টি তখন উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত হবে।

লেখক