-শাহজালাল 

কনকনে শীত কম¦ল মুড়িয়ে শুয়ে আছি। রাত বারটা পয়তাল্লিশ। পৃথিবীর সকল কর্মকান্ড কম্বল গায়ে কল্পনায় করা সম্ভব, আমাদের মত অলসদের। অলস নির্বাচন করে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করার কোন পরিকল্পনা থাকলে আমার জন্য খুব উপকার হয়। সম্ভবত প্রথম অলসদের মধ্যে আমিই প্রথম নোবেল বিজয়ীর খাতায় নাম লেখাতাম। অলস ব্যাক্তিদের কল্পনায় সব থাকে বাস্তবে ফকির থেকেও দরিদ্র। প্রচন্ড প্র¯্রাব পেয়েছে, কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না । কোন রকম চোখ বুঁজে শুয়ে আছি । ভাবছি যদি ঘুম চলে আসে, তাহলে কম্বল ছেড়ে উঠতে হবে না। না, আর হলো না প্র¯্রাবের বেগ ছাড়াও প্রকৃতির অন্য কাজটাও জেগে উঠেছে। অলস পাকস্থলি নড়েচড়ে বসেছে। প্রকৃতির কাজ মানে শান্তি আর শান্তি! বিলম্ব করলে অশান্তি আর অশান্তি! কম্বল ছেড়ে কোনরকমে উঠে পানির পাত্র নিয়ে দরজা খুলে প্রকৃতির কাজ সম্পন্ন করার জন্য দ্রুত হাঁটছি। বলে রাখি, বাড়ি আমার বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমানার নাফ নদীর পাড়ে। গাছ শূণ্য পাহাড়ের টিলায়। দরজা খুলে ডুকতে যাবো, তখনই চাপকলের শব্দ শুনতে পেলাম, ভয় পাইনি, আতংকিতও হইনি। শেষ করে বের হয়ে ফিরে আসবো, তখন আবার কল চাপার শব্দ শুনতে পেলাম । কিছক্ষণ পর পর কল চাপা হচ্ছে। এত রাতে কে হতে পারে? ভেবে পেলাম না। গোসলখানা টিলার মাঝামাঝি। পাশের বাড়ির লাইটের আলো গোসলাখানায় পড়াতে ভেতরে ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। হঠ্যাৎ করে দাদির কথা মনে পড়লো। দাদি প্রায় সময় বলতেন বাড়ির পেছনের উত্তর পূর্ব কোণে মাঝেমাঝে আলো দেখতে পাওয়া যেত। বিড়াল কিংবা কুকুর ডাকার আওয়াজ শোনা যেত। মোবইলের লাইট নিয়ে গোসলখানার দরজা দিয়ে উকি দিচ্ছি ভেতরে, কে? পনের ষোল বছরের এক অপরুপ মেয়ে। কানের দুল জোড়া সূর্যের আলোক রশ্নির মত জ্বলছে। পাশের বাড়ির দাদু প্রায় সময় বলেন, এই গ্রামে গভীর রাতে অতি সুন্দরী অলংকার পরিহিত বিয়ের সাজে সজ্জিত পরীকে দেখতে পাওয় যায়। পরী গ্রমের কারো ক্ষতি করে না। কারো উপর মন বসলে তার নাকি কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। অলস জীবন যাপন করে। উদাসিন হয়ে পড়ে। আমার উপর মন বসলে খুব ভাল হতো বাস্তবে আমি অলস আরও কত অলস হতে পারি দেখতাম! উদাসিনতা একটা গুণ, গুণ দ্বিগুণ হবে যদি আমায় পছন্দ করে। যাই হোক, দাদুর বলা কথার সাথে কিছুটা মিল থাকলেও অমিল রয়েছে যথেষ্ট। গোসলখানায় প্রবেশ করি। পরী আমায় দেখে আঁতকে উঠে হাত দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করে। পরীরা কী ভয় পায়? কল্পনাবিলাসী মানুষের একটাই দোষ! কল্পনা ্আর বস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে তাদের সময় লাগে। আমি দাঁড়িয়ে আছি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। কি অদ্ভুদ! কি অপরূপ! এত সুন্দর মেয়ে বাস্তব জীবনে নজরে পড়েনি। আজকেও কি বাস্তবে দেখছি? না, কল্পনায় কল্পিত রাজকুমারী আমার সম¥ুখে! ভাল হলো কল্পনার রাজ্যে সব কিছু পরিপূর্ণ! যা অপরিপূর্ণ ছিল, তাও আজ পরিপূর্ণ হতে চলেছে। চোখ বন্ধ করেছি, বরফের মত ঠান্ডা কোমল হাতের স্পর্শ শরীরে, অন্য রকম অনুভতি হলো। চোখ বুঝে অনুভব করছি। মনে হচ্ছে মেয়েটা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি আর নিরব থাকতে পারি নি। চোখ খুলে তার সম্পর্কে জানতে চাই, কিন্তু কিছ বলে না। দুই হাত মাথার উপর দিয়ে নিচে বসে পড়ে। মনে হচ্ছে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করছে। কেউ তাকে মারতে আসেনি, তা’হলে ? মনের ভেতর অজানা ভয় কাজ করছে। তখন পুরাপুরি কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসলাম। বুঝতে পারলাম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা, মিয়ানমারের বর্বরতা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বাংলাদেশে পাড়ি জমাচ্ছে হাজারো শরণার্থী। মেয়েটার শরীর দেখে গোসল করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম,আমার না মেয়েটার। হাত ধরে তুলি দাঁড়িয়ে আছে ছায়া মূর্তির মত। গোসল করবে কিনা জানতে চাইলাম,মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। শারীরিক অবস্থা দেখে বালতি পূর্ণ করে দাড়িয়ে রইলাম। একটা পুরুষ মানুষের সামনে একটা মেয়ে গোসল করবে, তা কি করে সম্ভব! আমি নির্লজ্জের মত দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটাও দাঁড়িয়ে আছে ছায়ামূর্তির মতো। আমি মানূষের সামনে সব সময় বোবা টাইপের, আজও তাই। কয়েক মিনিট পর মনে হলো গোসল করে মেয়েটা কি পরবে? এক দৌড়েঁ বাড়ি এসে একটি লুঙ্গি আর গেঞ্জি নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। গোসল শেষ হওয়ার পর শব্দ করে জানান দিল গোসল শেষ । চোখ বন্ধ করে প্রবেশ করলাম। লুঙ্গী আর গেঞ্জি ওর হাতে দিয়ে বের হয়ে এলাম। বের হওয়ার পর মেযেটা হাসলো বলে মনে হলো। আসলেই বোকাদেরও একটা ক্যাটাগরি থাকে। আমার কোন ক্যাটাগরি নেই। কাপড় পরে বের হয়ে এলো ও। মোবাইলের লাইট দিয়ে উপরে চলে এলাম। ওঠার পর দেখলাম ও নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। বাধ্য হয়ে নিচে নেমে হাত ধরে উপরে উঠতে সাহায্য করলাম। উপরে উপরে উঠে হাত ছাড়লো না ধরে থাকলোছ। উচ্চতা কম হওয়াতে বেশ আরাম করে ধরেছে । আমারও বেশ ভালো লাগছে। ক্লান্ত শরীর অন্যদিকে অসহায়। হাটার সময় বুঝতে পারলাম পায়ে সম্ভবত আঘাত লেগেছে, খুঁড়িঁয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বাড়িতে ঢুুকে চেয়ারে বসলাম। কি করবো বুঝে উঠতে পাই না।

মা আর ছোট বোন ঘুমে অচেতন, তাদের ডাকলে, কি, না কি হয়। মেয়েটাকে কোথায় রাখবো ভেবে পাচ্ছিলাম না! দাদি মারা যাওয়ার পর থেকে বারান্দায় থাকি। ভেতরে কেমন যেন অসস্তি লাগে। বারান্দায় দুইটা চৌকি একটাতে আমি শুই। অন্যটা খালি থাকে। মেয়েটার সাথে আজ রাত্রি যাপন হবে দুজন দুই চৌকিতে। বিছানায় নিয়ে তাকে শুইয়ে দিতে চাইলাম, কিন্তু না করলো। মুখে কোন কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারছিলাম তার ভাষা। বিদ্যুতের আলোতে মেয়েটাকে স্বাদ মিটছে না। রুক্ষ হেসে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। ওর চেহারায় জাদু আছে। যতই দেখছি ততই ভালো লাগছে। হৃদয়ে অন্যরকম শীতলতা অনুভব করছি। তার চেহারা দেখতে দেখতে মনে হলো রুক্ষ হাসিটা ক্ষুধার্ত হাসি। উঠে পড়লাম আসলে সে কখন খেয়েছে ঠিক নেই। আর আমি এইদিকে রূপের সুধা পান করে চলেছি স্বর্থপরের মত। তাড়াতাড়ি করে রান্নঘরে চলে গেলাম ঠান্ডা। গ্যাসের জ্বালিয়ে গরম করলাম, জীবনে আমার প্রথম। করতে খুব ভাল লাগছে। মাঝেমাঝে যখন দেরি করে বাড়ি ফিরি তখন মা হাত ধোয়ার জন্য পানি পর্যন্ত গরম করে দেন। আমি খুব অবাক হই। মায়ের বয়স ষাট বৎসর। ষাট বৎসর বয়সেও ছোট্ট খোকার মত যতœ নেই। মা শব্দ পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম শব্দের মধ্যে একটি কিন্তু ভাবগত দিক থেকে সবচেয়ে গভীরতম শব্দ। এক সেকেন্ডে মা শব্দের পরিসমাপ্তি ঘটে। যদি চোখ বন্ধ করে দেখি তাহলে মাকে দেখা যায়। মায়ের সকল কর্মকান্ড। কি ভাবছেন, আমার মায়ের কথা বলছি? পৃথিবীর সকল মা সন্তানের জন্য নিবেদিত প্রাণ। যাইহোক, খাবার টেবিলে নিয়ে আসি। গরম পানি দিয়ে হাত ধুয়ে দেই। খাওয়া শুরু করে, প্রথমে আস্তে আস্তে খেলেও কয়েক লোকমা খাওয়ার পর খুব দ্রুত খেতে থাকে। আনন্দে বুক ভরে গেল । আসলে খাওয়ানোর মাঝেও সুখ আছে, আছে তৃপ্তি। খাওয়া শেষ করে প্লেট ধোয়ার জন্য হাতে নেই। আমি হাত থেকে প্লেট নিয়ে নিজে ধুয়ে রান্নাঘরে রেখে আসার পূর্বে ও শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ, আমাকে হাতের ইশারায় কি যেন বলার চেষ্টা করে। হাতের ইশারা পায়ের দিকে দেখায় । কম্বল তুলে পা দেখি, পায়ের পাতা ফুলে গেছে। জবাই করা মুরগীর মত কাটাতারে ছিঁড়ে রক্তাক্ত হয়ে আছে। গোসল করাতে একটু একটু পানি পড়ছে। খুব মায়া হয়। ভেতরের রুম থেকে সেভলন নিয়ে আসি। তুৃলো না পেয়ে বালিশ ছিড়ে তুলা নিয়ে পরিষ্কার করি। শুয়ে পড়ার জন্য লাইট বন্ধ করবো তখনই দেখতে পাই ঠোঁটের কোণে ভাত লেগে আছে। মুখ ঠিকমতো পরিষ্কার করেনি। গামছা দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে আমার বিছানায় চলে আসি। সৃষ্টিকর্তা নিজের হাতে এক মুঠো সৌন্দর্য দিয়ে মেয়েটাকে তৈরী করেছেন। অপুর্ণতা নেই, দাদি একটা কথা বলতেন, আল্লাহতায়ালা সবাইকে পরিপূর্ণ করে সৃষ্টি করেন না। কোননা কোনো কিছু অপরিপূর্ণ রাখেন। মেয়েটার কোন কিছু আমার কাছে অপরিপূর্ণ বলে মনে হয়নি। তবে হ্যাঁ,সৃষ্টিকর্তা পরিপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু জাতীয়তায় মেয়েটার অপরিপূর্ণতা। কল্পনায় জাল বুনতে বুনতে ঘুমিয়ে পড়ি। তখন রাতের শেষভাগ।কখনো মা ঘুম থেকে দেরি করে উঠার জন্য বকেন না। আজ ডাকাডাকি করেছেন উচ্চস্বরে। চৈতন্য ফিরে পেলেও কম্বল ছাড়িনি। একটু উঁকি মেরে দেখলাম, ছোট বোন মেয়েটাকে উঠোন থেকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। কী অদ্ভুদ! কী সুন্দর! কল্পনার পরিরা হার মানবে তার সৈার্ন্দয্যে। সৈার্ন্দয্য বর্ণনা করার মত যথাযথ জ্ঞান আমার নেই। তবে বেশ উপলব্দি করছি । তার দু’চোখ জোড়া সমুদ্রের চেয়ে গভীর , আকাশের চেয়ে বিশাল। তার মাঝে নিজেকে হারাতে বসেছি। চোখ যেন অন্য এক পৃথিবী। আগ্নেয় গিরি থেকে লাভা উদগ্রিভ হওয়ার মত এক ধরণের ভিন্ন রকম অনুভূতি অনুভব করছি। যা প্রেমিক কবিরা বেশ ভালো বুঝেন। নিজেকে প্রেমের কবি ভাবতে না পারি,

বোকাসোকা প্রেমিক ভাবতে কষ্ট হচ্ছেনা আজ।এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে ভেতরের রুমের দরজায় দাঁড়িয়েছি। মা আর মেয়েটা বিছানায়, ছোট বোন গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে । মা নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে, মেয়েটা ও খাচ্ছে। মেয়েটার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি প্লেটে পড়ছে। অবর্ণনীয় আবেগ মাখা চেহারায় মায়ের দিকে বারবার দেখছে। মায়ের মায়া পরিবেষ্টিত চেহারায় এক টুকরো তৃপ্তিময় প্রাণবন্ত হাসি। ঠিকই আছে চোখের কোণায় দু’ফোটা জল। আমি ও যদি লিওনার্দো দ্য ভিন্জির মত আকঁতে পারতাম। ঠিকই একেঁ ফেলতাম মোনালিসাকে হার মানানো ছবি। কিংবা জীবনানন্দের বনালতা সেনের চেয়ে ছন্দময় প্রেমের কবিতা। আমি বোকাসোকা কল্পনা বিলাসী মানুষ, হৃদয় গহীনে কল্পনার রংতুলি দিয়েএকেঁছি নিজের মত করে । রংয়ের কোন ঘাটতি নেই , নেই কোন ছন্দহীন শব্দ।মায়ের চোখ আমার দিকেপড়া মাত্রই চোখ জোড়া আগুনের কয়লার মত লাল হয়ে উঠে।মুখ হিং¯্র বাঘের চেয়েহিং¯্র হয়ে উঠে। চোখে মুখে আমার উপর ঘৃণা আর ক্ষোভ। অবাক না হয়ে পারলাম না! মা কখনো আমার উপর রাগলেও এভাবে তাকান না। আজ কী হলো মায়ের? ভাবতে পারছিনা! ছোট বোন এগিয়ে এসে চোখ মুখ লাল করে বলে ‘ সব পুরুষ এক’ । আমি আকাশ থেকে পড়লাম । কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ি। বুঝতে পেরেছি , মেয়েটা কুড়িয়ে কুড়িয়ে হাটার কারণে অন্য কিছু ভেবে বসেছেন। ভাববার বিষয়! ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসা অনেক নারী সীমানার এপার ওপারের কিছু বখাটের হাতে ধর্ষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ছোট বোনকে বলতে পারতাম‘আমি শুধু পুরুষ নই , আমি মানুষ।” কেন বলব? হয়তো যুক্তি দিয়ে বুঝাতে পারতাম। যুক্তি দিয়ে বুঝালে বাধ্য হয়ে বুঝতে চেষ্টা করবে।যখন নিজে নিজে বুঝবে, আপসোস করবে। যাইহোক, অসহায়, আশ্রয়হীন মেয়ে আশ্রয় পেয়েছে তাতেই খুশি। মায়ের পরিবর্তে মা পেয়েছে। জন্মভ’মির পরিবর্তে জন্মভ’ুমির মত একটা দেশ। আমার মত বোকাসোকা কল্পনা বিলাসী মানুষ স্বশরীরে অপ্সরার সন্ধান পেয়েছে।

(কাটা তারের বেড়া পেরিয়ে

এসেছো তুমি আমার ঘরে

তুমি শরণার্থী নও

তুমি আমার অপ্সরা।)