আতিকুর রহমান মানিক
৯ আগস্ট আজ । বাহাত্তর বছর আগে ১৯৪৫ সালের এই দিনে জাপানের নাগাসাকি শহরের আকাশে মৃত্যুদূত হয়ে দেখা দেয় প্লুটোনিয়াম বোমা ‘ফ্যাট ম্যান’। এর মাত্র তিন দিন আগেই সমৃদ্ধ নগরী হিরোশিমায় ইউরেনিয়াম বোমা ‘লিটল বয়’র আঘাতে ঘটে গেছে নারকীয় এক হত্যাকাণ্ড। সেই দগদগে ঘায়ে যেন আরও বড় আঘাত হয়ে দেখা দিল নাগাসাকির হত্যাকাণ্ড। ৬.৪ কেজির (১৪ পাউন্ড) প্লুটোনিয়াম কোরের ‘ফ্যাট ম্যান’ ছিল ‘লিটল বয়’র চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ষষ্ঠ ও শেষ বছরে প্রবেশের পর মিত্রবাহিনী, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের মূল ভূখণ্ডে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে তৎকালীন মার্কিন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল জর্জ সি মার্শাল মেজর জেনারেল লেসলি গ্রোভসের কাছে সম্ভাব্য পরমাণু হামলার লক্ষ্য কি হবে তা জানতে চান।

এর পরপরই ম্যানহাটন প্রোজেক্টের প্রধান গ্রোভস একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি সে বছর ২৮ মে জাপানের পাঁচটি স্থানের নাম প্রস্তাব করে। দেশটির সবচেয়ে বড় সামরিক ভাণ্ডার এলাকা কোকুরা; পোতাশ্রয় ও শিল্পাঞ্চল হিরোশিমা; জঙ্গিবিমান, যুদ্ধাস্ত্র, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম প্রস্তুত কেন্দ্র, তেল শোধনাগার ও নগরাঞ্চল ইয়োকোহামা; তেল শোধনাগার, শিল্পাঞ্চল ও বন্দরনগরী নিগাতা; ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্র কিয়োটো। প্রায় এক মাস পর ২৫ জুলাই কিয়োটোর পরিবর্তে নাগাসাকির নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয় এ তালিকায়।

১৯৪৫ সালের ৮ মে জার্মান নাৎসি বাহিনী আত্মসমর্পর্ণ করে। সেই সঙ্গে এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত তিন দফায় জাপান আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু হামলার পরিকল্পনায় রদ আসে না যুক্তরাষ্ট্রের। সমালোচকরা মনে করেন, আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দম্ভ প্রকাশের লক্ষ্যেই পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।

১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টকে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন একটি চিঠি দেন। এই চিঠির মাধ্যমেই ঘটনার শুরু। জার্মানি তখন ইউরেনিয়াম বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। চেকোস্লাভাকিয়া অভিযানে ছিনিয়ে নেওয়া ইউরেনিয়াম তখন নাৎসি বাহিনী সযত্নে আগলে রাখছে। এমনই এক সময় ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করেন হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী লিও জিলার্ড।

এর ছয় মাস আগেই ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া আবিষ্কার করে ফেলেছেন জার্মান বিজ্ঞানী অটো হ্যান। তার সহকারী ছিলেন ফ্রিজ স্ট্রাসম্যান। লিও জিলার্ড আইনস্টাইনকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে বোমা তৈরি সম্ভব। তারা আশঙ্কা করছিলেন, নাৎসি বাহিনী যেকোনো দিন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাবে। এরই প্রেক্ষিতে মিত্রবাহিনীকে সাবধান করে দিতে ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার তাগিদে চিঠিটি লিখেছিলেন আইনস্টাইন। তার এ চিঠিই ‘ম্যানহাটন প্রোজেক্টের’ জন্ম দেয়।

১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কঠোর গোপনীয়তায় মেজর জেনারেল লেসলি গ্রোভসের নেতৃত্বে ম্যানহাটন প্রোজেক্ট পারমাণবিক বোমা তৈরিতে কাজ করে। এরই ধারায় জন্ম হয় ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’ নামের দুই মৃত্যুদূতের।

১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই পরিচালিত হয় ট্রিনিটি পরীক্ষা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ম্যাক্সিকোতে লাওস আলামোসের কাছে এ পরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষার পরপরই পারমাণবিক বোমার জনক বলে পরিচিত মার্কিন বিজ্ঞানী জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহেইমার সদম্ভে বলে ওঠেন, এখন আমি পৃথিবীর মৃত্যু আর ধ্বংসে পরিণত হয়েছি।

ট্রিনিটি পরীক্ষা সফল হওয়ার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর অভিপ্রায়ে ছিল। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমার আকাশে ও ৯ আগস্ট নাগাসাকির আকাশে দেখা দেয় ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’।

হিরোশিমায় সফল বিস্ফোরণের পর মার্কিন বাহিনীর দ্বিতীয় হামলার পরিকল্পনা ছিল ১১ আগস্ট কোকুরায়। নাগাসাকি ছিল তাদের দ্বিতীয় পছন্দ। কিন্তু আবহাওয়াবিদরা জানালেন, ১০ আগস্ট থেকে পাঁচ দিন আবহাওয়া খারাপ থাকবে। এ কারণে হামলার সময় এগিয়ে ৯ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়।

৯ আগস্ট স্থানীয় সময় ভোর ৩টা ৪৯ মিনিটে ফ্যাট ম্যানকে বহনকারী বিমান উড়াল দেয় কোকুরার উদ্দেশে। এর আগের দিনই ইয়াহাতায় মার্কিন বাহিনী বিমান হামলা চালিয়েছে। শহরটি কোকুরার কাছে অবস্থিত হওয়ায় এই হামলায় কোকুরার আকাশ ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। ফলে দু’বার চেষ্টা করেও সেখানে ফ্যাট ম্যানকে ফেলতে পারেনি মার্কিন বাহিনী। পরবর্তীতে তারা নাগাসাকির উদ্দেশে রওনা হয়।

স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৫০মিনিটে জাপানি রাডারে মার্কিন জঙ্গিবিমানের অস্তিত্ব ধরা পড়লে একবার ‘বিপদ সংকেত’ জারি করা হয়। সাড়ে ৮টায় এ সংকেত আবার প্রত্যাহারও করে নেওয়া হয়। ১০টা ৫৩ মিনিটে নাগাসাকির আকাশে আবার দু’টো জঙ্গিবিমান দেখা দেয়। জাপানিরা তখন মনে করলো, পরিদর্শন করতেই বিমান দু’টো ঘোরাফেরা করছে। এরই কয়েক মিনিট পর স্থানীয় সময় ১১টায় তিনটি প্যারাসুটে ভর দিয়ে নাগাসাকির আকাশে উড়তে দেখা যায় ফ্যাট ম্যানকে। ওড়ার ৪৭ সেকেন্ডের মাথায় ১১টা ১ মিনিটে এটি বিস্ফোরিত হয়।

বোমাটি নাগাসাকির একটি টেনিস কোর্ট বরাবর ১ হাজার ৬৫০ ফুট ওপরে বিস্ফোরিত হয়। এতে সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকায় ৩,৯০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (৭০৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপের সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে ঘণ্টায় ১০০৫ কিলোমিটার (৬২৪ মাইল) বেগে বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে।

বিস্ফোরণে নাগাসাকিতে তাৎক্ষণিক ৭৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আর এর বিকিরণজনিত প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তীতে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেয় আরও লাখ খানেক মানুষ।

হামলার পরপরই ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান বলেন, “আমি পারমাণবিক বোমার ভয়বহতা বুঝতে পেরেছি। এটা সত্যিই দুঃখজনক, আমরাই এর ব্যবহার করলাম। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি এই মারণাস্ত্র শত্রুদের দিয়ে ব্যবহার না করিয়ে আমাদেরকে দিয়ে করিয়েছেন। এবং আমরা প্রার্থনা করছি, ঈশ্বর তার ইচ্ছাপূরণে এই অস্ত্র ব্যবহারে আমাদেরকে পথ দেখাবেন”।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমানবিক বোমা হামলার নারকীয় দৃশ্যপট ও গণহত্যার ৭২ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। পারমানবিক মারণাস্ত্রের ব্যাপক বিধ্বংসী ক্ষমতার তান্ডবলীলা দেখার পরেও কিন্তু এর উৎপাদন কমেনি। বরং শক্তির মদমত্ততা দেখাতে এ মারনাস্ত্রের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র। এসব দেশের প্রায় পনের হাজার তাজা পারমানবিক বোমার আওতায় এখন বিশ্ববাসীর বসবাস। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্য আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, বৃটেন ও চীন আজ স্বীকৃত পারমানবিক পরাশক্তি। ইসরাইল ও আমাদের নিকটতম দুই রাষ্ট্র ভারত এবং পাকিস্তানও পারমানবিক বোমার অধিকারী। অতি সম্প্রতি এ তালিকায় যোগ হয়েছে উত্তর কোরিয়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মজুদ ব্যাপক বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন প্রায় পনের হাজার পারমানবিক বোমা পৃথিবী নামক গ্রহটি ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আর কোন হিরোশিমা-নাগাসাকি ও মানব সভ্যতা যেন পারমানবিক বর্বরতায় আক্রান্ত না হয়, এই হোক আজকের অঙ্গীকার।

আতিকুর রহমান মানিক
ফিশারীজ কনসালটেন্ট ও সংবাদকর্মী,
মুঠোফোন – ০১৮১৮-০০০২২০।