– রহিম আব্দুর রহিম

মানব সভ্যতার চলমান প্রক্রিয়াই দু:খ-বেদনা, হাসি-কান্না, উত্থান-পতন, চরাই-উৎরাই। কর্মময় জীবনের মধ্যদিয়েই যে পরিসমাপ্তি ঘটে, তাই মানুষের ব্যক্তি জীবনের পট পরিবর্তন। তেল-মবিল, পানির সমন্বয়ে যন্ত্রের গতি, পাওয়ার; তেমনি মানব সভ্যতার দু:খ-বেদনা, কষ্ট, হাসি-কান্না, আনন্দ-উল্লাসের সমন্বয়েই উদ্দীপনা, অনুপ্রেরণা, সাহস সঞ্চারিত, জীবন হয়ে উঠে উজ্জীবিত। বাঙালী জাতি, শোষিত-শাষিত, নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়েছিল বলেই ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বোপরি স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ জাতি পেয়েছেন। স্বাধীনতার অগ্নিমশাল যাঁর হাতে প্রজ্জ্বলিত সেই পিতা, সেই নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্ব-পরিবারে নিহত হন ৭৫’র ১৫ আগস্ট।

এই আগস্ট শোকের, চেতনার, সাহসিকতার, প্রতিজ্ঞার, ধৈর্য-সহশীলতার সতর্কতা, শক্তি -গতি সর্বোপরি উজ্জীবিত হওয়ার। এই আগস্ট যেমন ইতিহাস বিনির্মানের তেমনি কলঙ্কের বটে। ২ আগস্ট আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্ম, একই মাসের ৬ আগস্ট, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু, ৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন চলচিত্র পরিচালক জহির রায়হান, এই মাসের ৮ তারিখ মারা যান ত্রৈলোক্য মহারাজ। ১৪ আগস্ট জন্ম নেন শ্রী কৃষ্ণ, ১২ আগস্ট মারা যান বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ আবার ১৫ আগস্ট জন্ম নেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। একই দিনে নির্মমভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধ শেখ-মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এই দিনই হাস্যকরভাবে জন্মদিবস পালন করেন বেগম খালেদা জিয়া।এই মাসেই শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের তিরোধান।১৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন কবি শামসুর রাহমান। এই মাসের আরেক কলঙ্ক ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা। আগস্টের অন্যতম কলঙ্ক ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা নিক্ষেপ। এই মাসের ২৬ তারিখ জন্ম নেন মাদার টেরেসা। এই দিনই পরলোগমন করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

পৃথিবীর সকল প্রাণ-প্রাণীর জন্ম ও মৃত্যু চলমান প্রক্রিয়া। এর মধ্যেই রয়েছে ব্যতিক্রম, কখনো ইতিহাস বির্নিমান, কখনো কলঙ্কের অধ্যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোনিকৃষ্ট কলঙ্ক জনক অধ্যায় ৭৫’র ১৫ আগস্ট এই দিনে জাতির জনক, রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ব-পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বেঁচে যান বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। ওই সময় প্রকৃতির প্রিয় কন্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী, শেখ হাসিনা তাঁর স্বামীর কর্মস্থল জার্মানিতে ছিলেন। বঙ্গপিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর আনুমানিক ২ সপ্তাহ আগে শেখ হাসিনা স্বামীর কর্মস্থল থেকে প্রিয় মাতৃভূমিতে এসেছিলেন। পুনরায় যখন তিনি, জার্মানিতে যান, তখন তিনি সঙ্গে নিয়ে যান ছোট বোন শেখ রেহানাকে। ১৫ আগস্টের ভয়াবহ ন্যাক্কার জনক হত্যাকান্ডের হাত থেকে রক্ষা পান দুই বোন। যে দুই বোন একদিনেই হারিয়েছেন মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয় স্বজন। ওই দিনের হারানো স্মৃতি তাঁরা কিভাবে বহন করছেন? আশ্চার্য! হিমালয়সম সাহসী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই। আছে তাঁর উত্তরসূরী আকাশসম ধৈর্য-শক্তির ধারক-বাহক দু’কন্যা। জেগে আছে মাটি-মানুষ, আলো-বাতাস।

বঙ্গবন্ধু জাতিকে শিখিয়েছেন কিভাবে পরাধীনতার শৃংখল ভাঙ্গতে হয়। কিভাবে মানুষকে মুক্ত হতে হয়। যে মহানায়ক, মহাকবি, মাটি মানুষের প্রাণান্ত জীবন্ত প্রতীক হিসেবে গণমানুষের ঘরে ঘরে প্রজ্জ্বলিত করছেন, মুক্তি আর স্বাধীনতার অগ্নিমশাল, সেই প্রদীপ্ত জলন্ত আগ্নেয়গিরিকে চিরতরে নিভিয়ে দেওয়ার ভ্রান্ত পথে হেঁটেছিল বিশ্বের সর্বকালের, সর্বযুগের নিকৃষ্ট নরঘাতক বেইমানরা। যারা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এবং ফোরাত কুলের সীমারের জঘন্য কর্মকান্ডকেও হার মানিয়েছে। উদ্দেশ্য সফল হয়নি, বরং কলংকিত ইতিহাসে বির্নিমান ঘটেছে কুলাঙ্গারদের।

স্ব-পরিবারে নিহত বঙ্গবন্ধু বেঁচে যাওয়া কন্যা শেখ হাসিনার কাছে জাতি আজ কি শিখতে পেরেছেন? একবারও কি তা আমরা চোখ বন্ধ করে কল্পনা করেছি! একবারও কি ভেবে দেখেছি! পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই, ইথারে -বেতারে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর পরতে পরতে ঘৃণার ঝড় বইছিল, ‘বাঙালিরা নিমক হারাম-বেইমান;’ বিবেক স্তব্ধ। হাসিনা-রেহানা কি সংবাদটি কি জেনেছেন কি জানেনি তা জানার দরকার নেই। তবে কোন এক সময় জেনেছেন এটাই সত্য। সমুদ্রসম শোকে ভেসেছেন দু’বোন। এতেও তারা কাতর নয়, পাথরও নয়। ধৈর্য, সাহস, সহনশীলতার পর্বতসম শক্তি দিয়ে সমুদ্রসম শোককে ডিঙ্গিয়ে শেখ হাসিনা জাতিকে শিখিয়েছেন, শক্তি এবং শক্তিশালী কাকে বলে। দেখিয়েছেন তাঁর মনোবল। কি তাঁর সাহস, ধৈর্য! শোক যে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা। হে পিতা (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)! তুমি মুক্তির, তোমাকে স্মরী জীবনে মরণে; হে নেতা (শেখ হাসিনা) তোমাকে কল্পনা করি সাহস ও শক্তিতে। আগস্ট কান্নার নয়, আগস্ট শোকের নয়, আগস্ট শক্তির- আগস্ট মুক্তির, আগস্ট প্রতিশ্র“তির নয় প্রতিজ্ঞার, আগস্ট জাতির পিতার জন্য আহাজারি নয়, পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন সমাপ্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ের; আগস্ট কোন হাস্যরসাত্মক জন্মদিবস পালনের নয়, আগস্ট দৃঢ় প্রতিজ্ঞার বিনির্মিত বাঙালি জাতির সার্বজনীন ‘ঘৃণা দিবস।’

লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মোবাইল: ০১৭১৪২৫৪০৬৬