রাশেদুল মজিদ:

কক্সবাজার বিএনপির ‘ঘাঁটি’ হিসেবেই পরিচিত ছিল। একসময় কক্সবাজারের ৪টি সংসদীয় আসনই ছিল বিএনপি’র দখলে। স্বাধীনতার পর কক্সবাজার থেকে একমাত্র মন্ত্রীও হন চকরিয়া-পেকুয়া আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। মেধাবী ওই বিএনপি নেতা সর্বশেষ বিএনপি’র সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারনী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতেও স্থান করে নেন। গত বছর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে সম্পাদকীয় পদ পান কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সাবেক সাংসদ লুৎফর রহমান কাজল। হাসিনা আহমদও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। এছাড়া ১৯৭৯ সালে বিএনপি সরকারের আমলে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় দলের সংসদীয় হুইপ ছিলেন টেকনাফ-উখিয়া থেকে নির্বাচিত তৎকালীন সাংসদ শাহজাহান চৌধুরী। বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হিসেবেও আছেন পেকুয়ার সন্তান বিএনপি নেতা মেজর জেনারেল (অব:) রহুল আলম চৌধুরী। দল ও সরকারে কক্সবাজার থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে আসছেন। কক্সবাজার অঞ্চলে বিএনপি’র স্থানীয় ও কেন্দ্রিয় পর্যায়ে শক্তিশালী এবং মেধাবী নেতৃত্ব থাকলেও ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি গত এক দশক ধরে বেশ বেকায়দায় ছিল রাজনৈতিক মাঠে। যদিওবা বিএনপি নেতাদের দাবী-সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণে মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম চালানো কঠিন ছিল। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের ‘রোডম্যাপ’ ঘোষনা ও রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহনের বিষয়ে তৎপরতা শুরুর পর পরই কক্সবাজার বিএনপিতে বেশ চাঙ্গাভাব লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রিয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচির নামে মূলত: দলটি কক্সবাজারের তৃণমূল পর্যায়ে আগামী নির্বাচনের জন্য মাঠ প্রস্তুতে নেমে পড়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্রটি জানায়, আগামী সংসদ নির্বাচনে জেলার ৪টি সংসদীয় আসনই পুনরায় ফিরে পেতে চায় বিএনপি। বিষয়টি মাথায় রেখেই মূলতঃ কাজ চলছে পুরোদমে। এর অংশ হিসেবে ইতিমধ্যেই দলীয় কোন্দলও মিটিয়ে ফেলা হয়েছে। শাহজাহান গ্রুপ-কাজল গ্রুপ হিসেবে পরিচিত দীর্ঘদিনের বলয়ও ভেঙ্গে ফেলা হয়। কোন্দল ভুলে দু’পক্ষই এখন সমন্বয় করে দল চালাচ্ছেন। প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা নিচ্ছেন ভারতের শিলংয়ে থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের কাছ থেকে। সামগ্রিক সাংগঠনিক কাজের চেয়ে সংসদীয় আসন ভিত্তিক সাংগঠনিক কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। জেলা বিএনপি’র শীর্ষ নেতারাও এখন জেলা বিএনপি’র কমিটির চেয়ে সংসদীয় আসন ভিত্তিক দলীয় কর্মকান্ড নিয়ে মনোযোগী হয়ে পড়েছেন। আর এসব শুধুমাত্র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, যে কোন পরিস্থিতিতে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নিবে বিএনপি। ওই লক্ষ্য নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে মাঠ গোছাতে ব্যস্ত নেতারা। এমনকি চারটি সংসদীয় আসনে যারা নির্বাচন করবেন, তাদের গ্রিন সিগন্যালও দিয়ে দেয়া হয়েছে। যে কোন মূল্যে পুনরায় চারটি আসনেই বিএনপি প্রার্থীদের জিতিয়ে আনা হবে- এমন প্রত্যয় বিএনপি নেতাদের।

বিএনপি’র একটি সূত্র জানায়, কক্সবাজারের চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে কক্সবাজার ০১ (চকরিয়া-পেকুয়া) ও কক্সবাজার-০২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) সংসদীয় আসন থেকে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করবেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমদ। কোন কারণে তিনি নির্বাচন না করলে সেক্ষেত্রে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে থাকছে চকরিয়া-পেকুয়ায় সাবেক সংসদ সদস্য হাসিনা আহমেদ এবং মহেশখালী-কুতুবদিয়ায় এটিএম নুরুল বশর চৌধুরী। এছাড়া কক্সবাজার-০৩ (কক্সবাজার সদর-রামু) আসনে সাবেক সাংসদ বিএনপি’র কেন্দ্রিয় কার্যনির্বাহী কমিটির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক লুৎফর রহমান কাজল এবং কক্সবাজার-০৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক হুইপ শাহজাহান চৌধুরী একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন। এ দু’টি সংসদীয় আসনে এখন পর্যন্ত বিএনপি’র কোন বিকল্প প্রার্থী নেই। এমনকি উখিয়া-টেকনাফ আসনে শাহজাহান চৌধুরীর ভাই শাহজালাল চৌধুরী জামায়াতের পক্ষে নির্বাচন করে আসলেও আগামীতে শাহজালাল চৌধুরীর নির্বাচনে অংশ নেয়ার সম্ভাবনাও নেই বলে জানা গেছে।

বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা জানান, চকরিয়া-পেকুয়া, মহেশখালী-কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর-রামু এবং উখিয়া-টেকনাফ সংসদীয় আসনে বিএনপি প্রার্থীরা একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছেন। এসব সংসদীয় আসন বিএনপি’র ‘রিজার্ভ’ বললে অতিরিক্ত হবে না। ভোট বিহীন অথবা কখনো কখনো নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে সংসদ সদস্য হয়েছেন আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টির সমর্থিত নেতারা। এসব আসনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি প্রার্থীকেই বিজয়ী করবে জেলাবাসী-এমনটা মনে করে বিএনপি ।

দলীয় কোন্দল ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড সর্ম্পকে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রিয় কার্যনির্বাহী কমিটির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক ও কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সাবেক সাংসদ লুৎফর রহমান কাজল বলেন, ‘বিএনপিতে কোন্দল বলে কিছুই নেই। তবে দলীয় রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা আছে। আমরা জেলা বিএনপি’র সাথে ঐক্যবদ্ধ আছি। জেলা বিএনপি’র বক্তব্যই আমার বক্তব্য।’

নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিএনপি সবসময় সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে। কারণ-সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগন বিএনপিকে নির্বাচিত করবে। অতীতে কক্সবাজারের আসনগুলোতে তাই হয়েছে। আমি এমপি থাকা অবস্থায়ও মাঠে ছিলাম, এখনও মাঠে আছি।’ দলীয় প্রার্থী সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি মাঠে আছি। প্রার্থী নির্ধারণের বিষয়টি দলীয় প্রধানের হাতে। দলীয় প্রধানের সিদ্বান্তই এখানে চূড়ান্ত।’

দলীয় কোন্দল ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড সর্ম্পকে জানতে চাইলে জেলা বিএনপি’র সভাপতি ও উখিয়া-টেকনাফ সংসদীয় আসনের সাবেক সাংসদ শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি একটি বৃহৎ দল। এতো বড় দলে প্রতিযোগিতা থাকাটা স্বাভাবিক। যা আছে তা প্রতিযোগিতা মাত্র। এছাড়া দলে চেইন অব কমান্ড আছে। জেলা বিএনপি’র নেতৃত্বেই দলীয় কর্মকান্ড চলছে। দলের বিরুদ্ধে তো কেউ কিছু বলছে না।’

মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের বিএনপি’র সাবেক সাংসদ আলমগীর মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ ফরিদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি একটি মিমাংষিত বিষয়। তিনি এখন বিএনপি’র কেউ নন। বিএনপি’র কোন কর্মকান্ডেও তিনি নেই। তাকে নিয়ে বিএনপি’র কোন মাথাব্যাথাও নেই। বিএনপি করতে চাইলে দলের নিয়মের মধ্যেই আসতে হবে। শৃংখলার বাইরে কেউ নন। মহেশখালী-কুতুবদিয়ায় সাংগঠনিক কমিটি রয়েছে, তারা সেখানে দলীয় কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। বর্তমানে সেখানে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচী চলছে।’

আগামী সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিএনপি শতভাগ নির্বাচনমূখী দল। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবীই তো করছে বিএনপি। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জেলার চারটি আসনই আসবে বিএনপি’র ঘরে।’ শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘কক্সবাজারে আলাদা করে নির্বাচনী প্রস্তুতির কোন দরকার নেই। নির্বাচনের জন্য মাঠ প্রস্তুত। জনগন সরকার পরিবর্তনের অপেক্ষায়। বিএনপি’র চলমান সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচীতে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া তাই প্রমান করে।’

উখিয়া-টেকনাফ আসনে বিএনপি’র প্রার্থী সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি আগেও মাঠে ছিলাম, এখনও আছি। উন্নয়ন না থাকায় উখিয়া-টেকনাফের মানুষ পরিবর্তনের আশায় বসে আছে। মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের উন্নয়ন নয়, উখিয়া-টেকনাফের মানুষ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সার্বিক উন্নয়ন চায়।’