প্রথম আলো:

আগামী সংসদ নির্বাচনে শক্তভাবে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। দলটি মনে করছে, সার্বিক পরিস্থিতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিকূলে। এ অবস্থায় নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিকে জোরদার করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে বিএনপি।

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা মনে করছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায় ক্ষমতাসীন দলের জন্য একটি বড় ধাক্কা। ওই রায়ে আদালত যেসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপির নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবির যৌক্তিকতা উঠে এসেছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এ রায়ের পর সরকারের ক্ষমতায় থাকার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কোনো সভ্য সরকার হলে এ রায়ের পর পদত্যাগ করত।’

ষোড়শ সংশোধনী সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের এক জায়গায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষভাবে এবং কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে না হতে পারে, তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে একটি
গ্রহণযোগ্য সংসদও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।’ তিনি মনে করেন, সংসদ ও নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণ আস্থা অর্পণ করতে পারছে না। এ দুটি প্রতিষ্ঠান যদি জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ থেকে বিরত থাকে, তাহলে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না।

আপিল বিভাগের এই রায়কে বিএনপি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে। দলটি মনে করছে, গতবারের মতো আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে করা সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় সহায়ক সরকার না হলে পরবর্তী কৌশল কী হবে, সেটা নির্ধারণের দিকে মনোযোগী হয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।

দলটির নেতাদের অনেকেরই মূল্যায়ন হচ্ছে, গত নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। তাই আবারও নির্বাচন বর্জনের পুনরাবৃত্তি চাইছেন না অনেকে। যদিও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না, বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না।

বিএনপির নেতারা বলছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো এবারও বিএনপিকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার কৌশল আঁটছে সরকার। এ লক্ষ্যে বিএনপিকে দুর্বল করা, নানামুখী চাপে রাখা, দল ও জোটে বিভক্তি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তাঁদের ধারণা, এরই অংশ হিসেবে কিছুদিন ধরে বিভিন্ন জোট গঠনের নানামুখী তৎপরতা চলছে, যাতে সরকারবিরোধী ভোটগুলো বিএনপির দিকে না গিয়ে নানা জায়গায় ভাগ হয়ে যায়। সরকারের এসব কৌশল বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।

জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি অবশ্যই নির্বাচনে যাবে এবং এর জন্য যতটুকু প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, আমরা নিচ্ছি। তবে আমরা মনে করি, নির্বাচনের সময় একটি নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। এর জন্য সহায়ক সরকারের বিকল্প নেই।’

বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন তাঁদের সব মনোযোগ একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে। এ লক্ষ্যে তাঁরা দলের নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি ও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরির কাজ করছেন। আগামী ডিসেম্বরের দিকে সংসদ নির্বাচনের দলীয় পথনকশা চূড়ান্ত করা হবে।

দলীয় সূত্র জানায়, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির জেলা কমিটি পুনর্গঠন চলছে। ইতিমধ্যে ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার ৫০টিতে আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্যে থাকায় বাকি কমিটি ঘোষণা স্থগিত আছে। সংশ্লিষ্ট নেতাদের কমিটি পুনর্গঠনের কাজ গুছিয়ে রাখতে বলা হয়েছে, যাতে তিনি দেশে ফিরলে দ্রুত কমিটি ঘোষণা করতে পারেন।

দলের নেতারা বলছেন, গুম, খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য, সামাজিক অনাচার বেড়ে চলছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত রাস্তাঘাটের মতোই বেহাল আছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সরকার আরও চাপে পড়বে, যার প্রভাব পড়বে নির্বাচনে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখেই বিএনপির সব কার্যক্রম চলছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যতটুকু জানি, বিএনপির অবস্থা তিন-চার মাস আগের চেয়ে ভালো এবং সংঘবদ্ধ। আগামী দুই-আড়াই মাসের মধ্যে কমিটি গঠন শেষ হলে মাঠপর্যায়ে সংগঠন অনেকটা শক্তিশালী হবে।’ তিনি বলেন, খালেদা জিয়া দেশে ফিরে জেলা সফরে বেরোবেন। তখন দলে গতিশীলতার সূত্রপাত হবে। এর ধারাবাহিকতায় বিএনপি একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের সুযোগ পেলে ভালো করবে।