প্রথম আলো:

সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রায়ের পর্যবেক্ষণ সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য একটা ধাক্কা হয়ে এসেছে। তারা এই পর্যবেক্ষণ মেনে নিতে পারছে না। আবার এই নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানেও যেতে চাইছে না। এ অবস্থায় অস্বস্তিকর সময় পার করছে ক্ষমতাসীন দল।

আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, তা সরকারের জন্য হজম করা কঠিন। এতে সংসদ এবং সাংসদদের মোটামুটি অযোগ্য হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। সরকার পরিচালনার ধরন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ, কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে গঠিত সংসদ ও সরকার নিয়ে এমনিতেই দেশে-বিদেশে সমালোচনা আছে। চার বছর ধরেই সরকার এই সমালোচনা কাটানোর চেষ্টা করে আসছে। ১৫৩ জন সাংসদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ হওয়ার বিরুদ্ধে রিটও হয়েছে। যদিও পরে তা হাইকোর্টে টেকেনি। এখন ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায় ও পর্যবেক্ষণের ফলে পুনরায় সরকারকে বিব্রত হতে হয়েছে।

অবশ্য সরকারি দলের নেতারা এ-ও মনে করছেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আসা ধাক্কা সাময়িক, সামলে ওঠা যাবে। এ জন্য বিচার বিভাগের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ধৈর্য ধরে এগোতে চায় সরকার। কারণ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়াই হচ্ছে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের রায় নিয়ে যাকে-তাকে কথা বলতে দলের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। দলীয় ফোরামে আলোচনা করে এই বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সরকার গত আট বছরে যে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে রেখেছিল, ষোড়শ সংবিধানের রায়ে আসা এসব বক্তব্য তাদের কিছুটা সুযোগ করে দিয়েছে।

সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে গত শুক্রবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রথম ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি সিলেটে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা আবার পাস করব এবং অনবরত করতে থাকব। দেখি জুডিশিয়ারি কত দূর যায়।’ আগের দিন বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিরোধীরাও এত নিষ্ঠুর সমালোচনা করেনি।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন প্রথম আলোকে বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে যেসব বিষয় এসেছে, এর অনেক কিছুই প্রয়োজনের বাইরে, অনভিপ্রেত। এখন সংসদের প্রতিক্রিয়া কী হয়, সেটা দেখার বিষয়।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে উন্নয়নের সূচকগুলো তুলে ধরে যে সুফল পেতে চেয়েছিল, তা অনেকটা চাপা পড়ে যাচ্ছে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায়। এর মধ্যে রয়েছে দেশব্যাপী আলোচিত কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা, যাতে সরকারি দলের লোকজন জড়িত। তুচ্ছ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি, পাহাড়ধসে প্রাণহানি ও সময়মতো প্রস্তুতির অভাবে হাওরের বাঁধ ভাঙার ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ। একটু বৃষ্টি হলেই দেশের বৃহত্তম দুই শহর ঢাকা ও চট্টগ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে, পানি নামার পর রাস্তাঘাটের কঙ্কাল দশা বেরিয়ে আসছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের বছর একের পর এক এসব পরিস্থিতি জনমত গঠনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন দলটির নেতারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, সব মিলিয়ে এখন আওয়ামী লীগের ওপর একটা রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে। এতে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সুপ্রিম কোর্টের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ।

সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, এ অবস্থায় বিচার বিভাগের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে যাওয়া ঠিক হবে না। আবার সরকার ও সংসদের মুখ রক্ষাও করতে হবে। এ জন্য জাতীয় সংসদই প্রকৃত ফোরাম। গত ৩ জুলাই ষোড়শ সংশোধনীর সংক্ষিপ্ত রায় দেওয়ার পর ৮ জুলাই জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদসহ বিভিন্ন দলের ১০ জন মন্ত্রী-সাংসদ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। এর আগের দিন ৭ জুলাই আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের এক বৈঠকে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাই বিষয়টি আলোচনায় আনেন। আগামী সেপ্টেম্বরে পুনরায় অধিবেশন বসতে পারে। তখন আবার আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে।

দলের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যতবারই দলীয় প্রধানসহ নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, ততবারই তাঁরা সরকারের ভালো কাজ প্রচারের পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের খারাপ কাজ প্রচারের নির্দেশ করেছেন। এরপর দলের সংসদ সদস্যসহ নেতাদের অনেকেই এলাকায় গিয়ে উঠান বৈঠকসহ বিভিন্ন কর্মসূচি শুরু করেন। কিন্তু যেভাবে দলীয় লোকদের একের পর এক নেতিবাচক খবর বের হচ্ছে, তাতে ভালো কথা চাপা পড়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে ওই দুই নেতা বলেন, আগে যেসব বিষয় এতটা গুরুত্ব পেত না, এখন সেগুলোও ইস্যু হয়ে যাচ্ছে। যেমন বগুড়ায় শিক্ষার্থী ধর্ষণ এবং মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনা এখন সারা দেশে আলোচিত বিষয়। মৎস্য প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের দেওয়া ছাগল মরার ঘটনা ফেসবুকে দিয়ে ৫৭ ধারার মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে এক সাংবাদিককে, যা মন্ত্রী ও দলকে সারা দেশে পরিহাসের পাত্র করেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতাকেও সুশাসনের অভাব হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এর আগে হাওরে বাঁধ ভাঙন আর পাহাড়ে ভূমিধস—সবই সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়েও এর প্রশংসা পাচ্ছে না সরকার। একটা ঘটনার রেশ না কাটতেই আরেকটি অঘটনের খবর বের হচ্ছে। কিছুদিন পরপরই স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাত, খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে।

এ বিষয়ে কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ১৭ কোটি মানুষের দেশ। এসব সমস্যা আছে সত্য। এগুলো রাজনৈতিক সমস্যা নয়। আর দল ও সরকার কাউকে ছাড় দিচ্ছে না, কোনো ঘটনাকে এড়িয়ে যাচ্ছে না—এটাই বড় কথা।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলের কৌশল কী হয়, এটা এখনো পরিষ্কার নয়। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তা আছে।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এখন যে বেকায়দায় পড়েছে, তা এক দিনে হয়নি। শাসনব্যবস্থার গলদ আছে। গণতন্ত্র চর্চায় সমস্যা আছে। সুশাসনের অভাব প্রকট। উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্রের যে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, সেটা কাজ করছে না। এটা সরকারকে মেনে নেওয়ার সময় এসেছে। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে উদ্ধত আচরণ ও শিষ্টাচার না মানার যে প্রবণতা আছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই সমস্যার সমাধান আসবে।