মুহাম্মদ আবু হানিফ খান :

রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন প্রকাশ্যে আমাদের সামনে জাতীয় উন্নয়নের এক বিরাট অংশ খেয়ে ফেলছে যানজট নামক এক বাঘ। এ বাঘের কবল হতে রক্ষা পাবার ক্ষমতা কোন সাধারণ মানুষের নাই। কেবল এই বাঘ কাবু করতে পারেনা আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কখনো কখনো অন্য মন্ত্রীর নির্বিঘœ চলার সড়ক পথকে। আমাদের শ্রমজীবী মানুষজন, যাদের শ্রম জাতীয় উন্নতিতে অবদান রাখে তারা এ বাঘের কবলে পড়লে একেবারেই অসহায় ও কাবু হয়ে পড়েন। ক’দিন আগে মতিঝিলের এক অফিস কর্মকর্তা মিরপুর হতে আসতে তার অফিস সময় প্রায় পুরোটাই খুইয়ে ফেললেন যানজটের কবলে পড়ে বাসে বসে। আক্ষেপ করে বললেন, ‘দুপুরের খাবার সাথে আছে, যে টুকু সময় আছে তাতে অফিসে গিয়ে খাবার খেতেই পুরো অফিস সময় পার হয়ে যাবে; এরপর আবার শুরু হবে বাসায় ফেরার পালা, জানিনা কোন রাতে বাসায় ফিরতে পারব’। বাস্তবতা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, মতিঝিল বা গুলিস্তান হতে শাহবাগ পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার ৩০মিনিটের পথ গাড়িতে অতিকক্রম করতে কখনো ৩ঘন্টাও লেগে যায়। এমন ব্যাধিচিত্র এখন শুধু রাজধানী শহর ঢাকায় সীমাবদ্ধ নয়; এ রোগ সংক্রামিত হয়ে পড়েছ ঢাকার সাথে সংযোগ সড়ক সমূহের মাধ্যমে ঢাকার বাইরেও। এ ব্যাধি এখন শুধু সংক্রামক নয়; বরং এখন রূপ নিয়েছে ঘাতক ব্যাধিও মহামারি রূপে। যা দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির স্বাস্থ্যে এখন রীতিমত হুমকী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশের কর্তাব্যক্তি বা বড়-বড় চেয়ার ওয়ালাদের গালভরা বুলি নিজেদের দায় হতে খালাস ভাবতে পারেন। তবে হর-হামেশা যত্র-তত্র রাস্তা খোড়াখুড়ি ও যুগ-যুগান্তর ধরে উড়াল সড়ক বা ফুট ওভার ব্রিজ নির্মাণ করে এসবের সমাধান সম্ভব হবে এমনটা বলা যায় না; তবে যা হবার তা হলো- কারো-কারো পকেট ভারী করার মহরত আর গণভোগান্তি। এটা করা হবে, ওটা করা হবে, করছি, করবÑএসব শুনতে-শুনতে এখন আর সাধারণের ভালো লাগে না। রামপুরা-বাড্ডা ও যাত্রবাড়ী থেকে কাজলা ৫ মিনিটের পথও নয়, অথচ ৬ মাসেও এ রাস্তার কাজ শেষ হচ্ছে না, ৫ বছরেও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার সম্পন্ন হয়নি যেখানে; সেখানে আবার এমআরটি, বিআরটি, পাতাল রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়া দেখতে পারা কতজনের নসীব হবে তা আল্লাহ মালুম।

রাস্তার সংস্কার কাজ করতে অবতীর্ণ হয় রাজউক, ডেসা, ওয়াসা, ডেসকো। আলাদাভাবে গড়ে ওঠা ও সমন্বয়হীনভাবে কাজ করায় কাজের কাজ তেমন হচ্ছে না। গেল দশকে যানজটের কবলে পড়া সময় অপচয় ঠেকাতে পারলে বাংলাদেশ বহু আগেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারতো। বিশ্বদরবারে শহর হিসেবে ঢাকা’র অখ্যাতির কমতি নাই। একবার ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক জরিপে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা শহর হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যা প্রতি বছর দেশের আর্থিক ক্ষতি করছে বিলিয়ন ডলার পরিমান। যানজটের কারণে বছরে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, অঙ্কের হিসেবে তা ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। পরিসংখ্যান মতে, ঢাকায় যানবাহনের বর্তমান গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার। কখনো-কখনো এ গতি ১কিলোমিটারেও নেমে আসে। গাড়ির সংখ্যা যদি বর্তমান গতিতে বাড়তে থাকে, ২০২৫ সাল নাগাদ গড় গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৭ কিলোমিটারে নেমে আসবে, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কম। অথচ মানুষের স্বাভাবিক হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারের উপরে।

যানজট এখন শুধু রাজধানীর বিড়ম্বনাই নয়; বরং যানজট দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি থামিয়ে দিচ্ছে। এ ভয়ংকর সমস্যা দেশের উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে, দেশের রফতানি বাণিজ্য অনিশ্চিত করে তুলছে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বিঘিœত হচ্ছে। যানজটের কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে এখন অস্বস্থির দৃষ্টিতে দেখছেন। ঢাকা যেন এক মৌচাক, মানুষজন যেন মৌমাছি। মধুর লোভে পারলে ১৬ কোটি মানুষই যেন চায় ঢাকায় সেটেল হতে। দেশের প্রতিটি এলাকা হতেই রাজধানীতে প্রতিদিন মৌমাছির মত ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসছে দাফতরিক প্রয়োজন বা জীবিকার জন্য কাজের খোঁজে। এর কারণ ঢাকাকে বেশি-বেশি কেন্দ্রীয়করণ করার জন্য। শুধু ব্যবসা-চাকুরী বা ভাল শিক্ষার জন্যই নয়; এ শহর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, ছিনতাই এমনকি ভিক্ষার জন্যও মানুষজনের চাপ দিন-দিন বাড়ছে।

গণমানুষের ঢাকায় গণপরিবহণের তুলনায় জনপরিবহণ সংখ্যা বহুগুণ বেশি। ব্যক্তিগত গাড়ীগুলো দখল করে নেয় ঢাকার বেশিরভাগ রাস্তা। এতে কোনোটিতে যাত্রী থাকে আবার কোনোটিতে থাকে শুধু ড্রাইভার। গণপরিবহণের গাড়ী থাকে এর ফাঁকে-ফাঁকে। যাতে যাত্রী থাকে ঠাসা-ঠাসা। ঢাকায় ৯০ শতাংশ মানুষ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট যাতায়াত করলেও রাস্তা প্রায় ৯০ভাগ দখলে থাকে প্রাইভেট গাড়ীর। ঢাকায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে প্রাইভেট বিদ্যালয়। যেখানে ধনীদের সন্তানই বেশি। তাদের সন্তানরা যেমন প্রাইভেট গাড়ীতে স্কুলে আসা-যাওয়া করে তেমন বেশিরভাগ সরকারী কর্মকর্তার সন্তানও স্কুলে আসা-যাওয়া করে সরকারি প্রাইভেট গাড়ীতে চড়েই। ফলে দেখলে মনে হয় স্কুল সময় যেন রাস্তায় বসে প্রাইভেট গাড়ীর মেলা।

ঢাকার ফুটপাত! সে আর এক কাহিনী। ফুটপাথে পথচারীরা হাঁটার সুযোগ বড় একটা পান না। এ সব থাকে রাজনৈতিক মাফিয়ার স্থানীয় মাস্তানদের মালিকানায়। যেখানে চলে পুলিশ-মাস্তান পার্টনারশিপ বিজনেস। সড়ক-বাণিজ্যের কারণে দোকানের পিঠে দোকান বসিয়ে ফুটপাথের সাথে দখল করে নেওয়া হয় রাস্তাও। প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস ঢাকায়। বিশ্বব্যাংক মনে করছে এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালে ঢাকায় জনসংখ্যা হতে পারে ৩ কোটি ৫০লাখ। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজধানীতে যানজটের অন্যতম কারণ ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি। যানজট শুধু রাস্তার সমস্যা নয়, এটা আমাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, প্রশাসনিক অদক্ষতার ফসল।

ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত করা কেউ কেউ স্বপ্নবিলাস মনে করলেও অসম্ভব কিছু নয়। প্রয়োজন শুধু সরকারের সদিচ্ছা। প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, জনগণের প্রতি আস্থা ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ঢাকাকে কেন্দ্রীয়করণের পরিবর্তে বিকেন্দ্রীকরণ করলে শুধু যানজট নিরসনই নয়; বরং দেশের ৬৮হাজার গ্রামই শহরেরর নাগরিক সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। এক্ষেত্রে ক্ষমতা রক্ষা বা ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে শঙ্কা ভুলে সিংহাসন জয়ের নীতির পরিবর্তে জনগণের হৃদয় জয় করার নীতিতে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগ বা দফতর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ বা জেলা শহরে স্থাপন করা যায়। গার্মেন্টস কারখানাগুলো নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করা। ঢাকায় কোন ধরণের শিল্প কারখানা না রাখা। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বা ক্যাম্পাসাংশ গ্রামাঞ্চলে স্থানান্তর করা এবং শিক্ষার্থীদের সেখানে থাকার জন্য আবাসিক ব্যবস্থা গড়ে তোালা। ফলে সেশনজট ও সন্ত্রাস বহলাংশে কমে যাবে। শহরমূখি অভিবাসন ঠেকাতে গ্রাম ও শহরেরর ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। এজন্য বিকেন্দ্রীকরণ পদ্ধতিই হচ্ছে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি।

ঢাকার পাশে একটি স্যাটেলাইট সিটি করে সেখানে সচিবালয়সহ সরকারি অফিসগুলো নিয়ে ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলে দূরত্ব কোনো সমস্যা নয়। একই সঙ্গে দোতলা বাস চালু করা; বর্ধিত ঢাকার সঙ্গে মূল ঢাকায় চলাচলের জন্য অধিকসংখ্যক বাইপাস সড়ক নির্মাণ; রাস্তাাগুলো দখলমুক্ত করা প্রয়োজন। রাজপথ দখল করে রাজনৈতিক দলের সভ-সমাবেশ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। এক্ষেত্রে রাজধানীর ঊদ্যান বা মাঠগুলো কাজে লাগানো যেতে পারে। যানজট নিরসনে এমন বহুবিধ ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার, বিরোধীদল ও জনসাধারণকে সহনশীল ও সহযোগিতামূলক ভূমিকা রাখতে হবে।

এসব করতে সরকারকে প্রতিহিংসা, দলীয় স্বার্থ ও ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধে উঠে দৃঢ়তার সাথে ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এছাড়া নগরবাসীকেও তাদের নাগরিক দায়িত্ব পালনে সচেতন এবং রাস্তার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

লেখক, প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ,বাংলাদেশ মিডিয়া ইনস্টিটিউট ও কেন্দ্রীয় সভাপতি, বিএমআই সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট। ই-মেইল: bmibd13@gmail.com  ফোন:০১৭৩০৮৯০০০০