মো. নুরুল করিম আরমান, লামা:
টানা ৫ দিন ধরে থেমে থেমে প্রবল বর্ষণের ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফের বন্যাসহ ব্যাপক হারে পাহাড় ধস আতংকে ভুগছে বান্দরবানের লামা উপজেলাবাসী। ইতিমধ্যে উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে প্রায় ৩০টির মত ঘরবাড়ি ও প্রধানসড়কসহ বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীন সড়কের ওপর পাহাড় ধসে পড়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বিপদ সীমায় পৌঁছেছে মাতামুহুরী নদীর পানি। এর সাথে পাল্লা দিয়ে লামাখাল, ইয়াংছা খাল, বগাইছড়িখাল, বমুখাল, লুলাইং খাল, ডলুখাল, ইয়াংছা খাল ও পোপা খালসহ বিভিন্ন স্থানের পাহাড়ি ঝিরিগুলোতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বিভিন্ন পেশাজীবির প্রায় ৫ হাজার মানুষ। খালের পানির স্রোতের টানে ডুবে গিয়ে জাবের আহমদ (৪৫) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এ টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ বন্যাসহ পাহাড় ধসে মানবিক বিপর্র্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। পাহাড় ধসে প্রানহানির আশঙ্কায় উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর পক্ষ থেকে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদেরকে নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। বন্যা কবলিতদেরকে আশ্রয় নেওয়ার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের আবাসিক কোয়ার্টার সমূহ খুলে দিয়েছে প্রশাসন। মঙ্গলবার সন্ধ্যা নাগাদ এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থেমে থেমে বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে।

জানা গেছে, গত শুক্রবার সকাল থেকে লামা উপজেলায় থেমে থেমে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। আর এ বর্ষণের ফলে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে উপজেলায় অবস্থিত নদী, খাল ও ঝিরির পানি ফুঁসে উঠে। বর্ষণ অব্যাহত থাকলে মঙ্গলবার দিবাগত রাত নাগাদ লামা পৌর এলাকার নয়াপাড়া, বাসস্টেন্ড, টিএন্ডটি পাড়া, বাজারপাড়া, লামা বাজার, চেয়ারম্যান পাড়ার একাংশ, ছোট নুনারবিলপাড়া, বড় নুনারবিলপাড়া, লাইনঝিরি, ফকিরপাড়া, হাজ্বীপাড়া, কলিঙ্গাবিলপাড়া, উপজেলা পরিষদের আবাসিক কোয়ার্টার সমূহ, থানা এলাকা, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা বাজার, হারগাজা, বগাইছড়ি, বনপুর ও লামা সদর ইউনিয়নের মেরাখোলা, বৈল্লারচর, শীলেরতুয়া, দরদরী, অংহ্লাপাড়া, লামা-আলীকদম সড়কের ক্যায়ারাঝিরিসহ বিভিন্ন এলাকা নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার অতি বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে পাহাড় ধস। ইতিমধ্যে পৌরসভা এলাকায় ৭টি, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ৬টি, আজিজনগর ইউনিয়নে ৫টি ও ফাইতং ইউনিয়নে ৪টিসহ বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়ির ওপর পাহাড় ধসে পড়ে সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এসব ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। এছাড়া পাহাড় ধসে পড়ে, পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতের টানে ভেঙ্গে বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীন সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাকের হোসেন মজুমদার জানান, পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ে ও বর্ষণের পানির স্রোতের টানে ভেঙ্গে ইয়াংছা-বনপুর-কাঁঠালছড়া, বগাইছড়ি-হারগাজা-সাফেরঘাটা এবং লামা-ফাঁসিয়াখালী সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা স্থানীয়দের সহায়তায় বদুরঝিরি নামক স্থানে ধসে পড়া মাটি সরানোর ফলে লামা-ফাঁসিয়াখালী সড়ক যোগাযোগ মঙ্গলবার বিকাল নাগাদ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এছাড়া কুমারী এলাকার একটিসহ বিভিন্ন স্থানে আরও ৪-৫টি বসতঘর বিধস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আজিজনগর ইউনিয়নের স্কুল শিক্ষক শাহাজাজান ও চাঁন মিয়াসহ বেশ কয়েকটি বসতঘর ও সড়কের ওপর পাহাড় ধসে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন। লামা সদর ইউনিয়নের মেরাখোলা, বৈল্লারচরসহ নিচু এলাকাগুলোও প্লাবিত হওয়ার খবর জানান চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন। সরই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফরিদ উল আলম জানান, লুলাইং খাল পারাপারের সময় জাবের আহমদ নামের এক কৃষক মারা যান এবং বিভিন্ন পাহাড় ধসে বেশ কয়েকটি ঘরবাড়ি ও রাস্তা ঘাট বিধস্ত হয়েছে। রুপসীপাড়া, গজালিয়া ইউনিয়নেও পাহাড় ধসে ঘরবাড়ি বিধস্ত হওয়ার খবর দিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। এদিকে পৌরসভা ও বিভিন্ন ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে চলা খাল-ঝিরিতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে রয়েছে। লামা-আলীকদম সড়কের বিভিন্ন পয়েন্ট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আলীকদমের সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। প্রবল বর্ষণ অব্যাহত থাকায বন্যার আশংকায় স্থানীয়রা শংকিত হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসী। লামা শহর ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল এবং উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তর সমুহ বন্যার আশঙ্কায় মালামাল ও নথিপত্র নিরাপদে সরাদে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এদিকে আলীকদম উপজেলায়ও পাহাড়ি ঢলের নিচু এলাকা প্লাবিত ও পাহাড় ধসে কিছু ঘরবাড়ির ক্ষতি হয় বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

লামা পৌরসভার চেয়ারম্যান পাড়ার বাসিন্দা খোরশেদ আলম (৫৪) বলেন, গতরাত ১টার দিকে আমার বাড়ির উপর পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে। সতর্ক থাকায় প্রানহানির ঘটনা ঘটেনি। পাশাপাশি আরো ৩টি পরিবার এখনও মাটির নিচে বলে জানান তিনি। লামা পৌরসভার মেয়র জহিরুল ইসলাম সকালে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর পরিদর্শন করেন। অপর দিকে, আজিজনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পাড়ার বাসিন্দা মো. শাহজাহান মাষ্টার (৩৫) ও কামরুন্নাহার (৩২) বলেন, পাশের পাহাড় ভেঙ্গে বসতবাড়ি এখন মাটির নিচে। পার্শ্ববর্তী রাশেদা বেগম (৩৫) ও মো. মহসিন বলেন, আমরা ঝুঁকিতে আছি। জানিনা কখন আমাদের বাড়িতেও পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে।

লামা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারন সম্পাদক জাপান বড়ুয়া জানান, গত দুই দিনের বর্ষণে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঢলের পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যবসায়ী ও পরিবারগুলো তাদের মালামাল নিরাপদে সরিয়ে নিচ্ছেন। দ্রুত পানি বৃদ্ধির কারনে কেউ কেউ আবার ক্ষতির সম্মুখিন হয়। অতি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলের কারণে লামা পৌর এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে চলতি মৌসুমের বীজতলা এবং বিভিন্ন ফসলাদি অতি বৃষ্টি ও পাহাড় ধসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে কৃষি কর্মকর্তা মো. নূরে আলম জানিয়েছেন।

লামা পৌরসভা মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণে পৌর সভা এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে ঘরবাড়ি ও কাঁচা পাঁকা সড়ক বিধস্ত হয়েছে। পৌরসভার কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে বন্যার পরিস্থিতি সার্বক্ষনিক তদারকি করার জন্য কমিটি গঠন করার পাশাপাশি প্লাবিত লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রিত ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিতদের মধ্যে শুকনো খাবারের ব্যবস্থা আছে। তিনি আরও বলেন, মাইকিং করে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদেরকে নিরাপদে আশ্রয় গ্রহনের জন্যও দফায় দফায় তাগিদ দেয়া হয়েছে।

এ বিষযে লামা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী জানান, বন্যা কবলিতদের জন্য উচু জায়গায় অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ গুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে খোলা রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে পৌর এলাকাসহ ইউনিয়নগুলোতে মাইকিং করে জনসাধারনকে নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যনদেরকে বলা হয়েছে। লামা শহরকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে মাতামুহুরী নদীর গতি পরিবর্তন ছাড়া কোন উপায় নেই বলেও জানান তিনি।