আবদুল আলীম নোবেল :
সারাবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কক্সবাজারের পর্যটন খাত। পৃথিবীর এমনও দেশ আছে শুধুমাত্র পর্যটনের আয় দিয়েই চলে। এ খাত থেকে আমরাও হাজার হাজার কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখছি। সেটি বাস্তবায়নে বেশি দুর যেতে হবে না। অতিসম্ভাবনাময় এই পর্যটন খাতকে বাঁচাতে হলে অনেক বেশি দুরদর্শি চিন্তা করতে হবে আমাদের। যেভাবে কয়েক বছর ধরে কক্সবাজারে পাহাড়ি ঢলে বন্যা বেড়েছে। এটির স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না হলে সবচাইতে বেশি ক্ষতির শিকার হবে পর্যটন শিল্প। ‘কক্সবাজারে বন্যা’ শিরোনামে মিডিয়ার মাধ্যমে দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন বিদেশেও পৌঁছে গেছে সংবাদ। আর এর জন্য মিডিয়াকে আরো দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট পর্যটন ব্যবসায়িরা। কারণ বন্যা দুর্গত কবলিত এলাকায় তো পর্যটকরা ভ্রমণ করতে আসবেন না। কারণ টাকা খরচ করে দুর্ভোগ পোহাতে কেউ চান না।

বন্যা নিয়ন্ত্রণে কক্সবাজারে নেই কোন মাস্টারপ্ল্যান। শুধুমাত্র বর্ষা আসলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের তোড়জোড় বেড়ে যায়। পাহাড় কাটা থেকে শুরু করে ড্রেন ভরাট, এগুলোর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা। সরকার প্রতি অর্থ বছরে বন্যা নিয়ন্ত্রণে বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ নানান কাজে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। কিন্তু দুর্নীতি, অনিয়ম ও কর্মকর্তাদের গাফেলতিতে তার সুফল পাচ্ছেন না জনগণ। বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ করা মোটেও কষ্টসাধ্য না। শুধুমাত্র পরিকল্পিত কার্যক্রম চালিয়ে এবং সচেতনতার মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব। উল্লেখ্য, পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃত।

বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজারে বন্যা যেন অপরিহার্য। পানির প্রক্রিয়া, জলবায়ুর প্রভাব আর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে বন্যাপ্রবল দেশ। সে দিক দিয়ে কক্সবাজারও পিছিয়ে নেই। তবে আমাদেরকেও প্রক্রিয়াগতভাবে সামনের দিকে এগুতে হবে।

এবার পাহাড়ি ঢল আর সাগরের উজানের পানির প্রভাব এতই বেশি ছিল যে, নিত্য নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছিল আর পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল জেলার লাখ লাখ মানুষ। এসব মানুষ তাদের বসতবাড়ি ও সম্পদ হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধের ওপর, উঁচু স্থানে কিংবা খোলা আকাশের নিচে, এমনকি মহাসড়কের পাশেও। সবকিছু হারিয়ে এসব বানভাসি মানুষ অসহায় হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেছে।

বৃষ্টি হলেও প্রতিদিনই বাড়ে যায় পানির চাপ। ফলে বন্ধ হচ্ছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর যান চলাচল থেকে শুরু করে গ্রামীণ সড়কে চলাচল করতে বাড়ছে দুর্ভোগ। পানির নিচে ডুবে যায় সড়ক, মহাসড়ক ও বসতঘর। পানির প্রভাব এতই যে, দেখে বোঝা যায় না, কোনটি সড়ক কিংবা জলাধার। পানির কারণে মানুষ তাদের ঘরের চালেও আশ্রয় নেয়ার সুযোগ পায় না। এসব বানভাসি মানুষের টিউবওয়েল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় তারা বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে, আর সুপেয় পানির অভাবে শিশু-বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগে। একদিকে রোগ আর অন্যদিকে বন্যা- এই দুয়ে এসব অঞ্চলের মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।

এবার বন্যার পানিতে জেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে নারী ও শিশুদের অবস্থা বেশি যন্ত্রণাদায়ক।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বন্যায়। তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণে এবং এ ধরনের ক্ষতি এড়াতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর জোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকার প্রায় ৯ বছরে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এই জেলার নিম্নাঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে নদ-নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি, যা সত্যিই দুঃখজনক। শাহপরীর দ্বীপে বেড়ি বাঁধ, কুতুবদিয়ায় বেড়ি বাঁধ, পেকুয়া ও চকরিয়ার নিচু এলাকায় বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে আরো বেশি যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের উচিত, বন্যার্তদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে যা যা করণীয়, সবই করা।

প্রথমত, ত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে। ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলে এড়িয়ে গেলে চলবে না। সরকার যে পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করেছে, তা অপ্রতুল। মনে রাখতে হবে, বন্যার স্থায়ী সমাধান না হলে তা বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে অবশ্যই এসব এলাকার বীজ, ক্ষেত-খামার, ফসলি জমি ইত্যাদি রক্ষা করতে হবে। মনে প্রশ্ন জাগে, এসব মানুষের জন্য আমাদের কি কোনো দায়বদ্ধতা নেই।

বিশেষ করে, কক্সবাজার শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার আরো অনেক আধুনিক করতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বন্যার্ত মানুষের কল্যাণে কিছু পদক্ষেপ নেয়া বেশি জরুরি।

১. বন্যা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া। ২. বন্যার্ত মানুষের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা এবং এ ক্ষেত্রে শুধু সরকার নয়, চাই বেসরকারি সংস্থা এবং বিত্তশালী লোকদের সহায়তা। ৩. যেহেতু বন্যা প্রতি বছরই আমাদের দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে আঘাত হানে, সুতরাং বন্যাকবলিত বানভাসি মানুষের জন্য একটি সার্বজনীন ফান্ড গঠন করতে হবে। ৪. বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের জন্য নষ্ট হওয়া সড়ক-মহাসড়ক বা যোগাযোগ ব্যবস্থা মেরামতের কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হাতে নেয়া। ৫. ভারতের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য পানি বণ্টন চুক্তি সম্পন্ন করা, অন্যথায় আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হওয়া। ৬. বন্যা-পরবর্তী বিভিন্ন ধরণের অসুখ মোকাবেলার জন্য আগাম ব্যবস্থা নেয়া। ৭. বন্যা-পরবর্তী সময়ে কৃষকদের জন্য বীজ ও প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করা। ৮. বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ব্যাংক ঋণ মওকুফের ব্যবস্থা করা। ৯. অত্যাধিক ক্ষতিগ্রস্তদের ফসলি জমির ক্ষতির জন্য কিছু ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। ১০. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের টেকসই পরিকল্পনা হাতে নেয়া। ১১. জলাশয় ও পাহাড় সংরক্ষণ আইন আরও কঠোর করা। ১২. অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। ১৩. বাংলাদেশের প্রতিটি নদী-খাল-বিল প্রভৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া। ১৪. যতই ব্যয়বহুল হোক, প্রতি বছর নদী খননের কাজ হাতে নেয়া। ১৫. উপদ্রুব এলাকার মানুষদের দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ১৬. প্রয়োজনীয় আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা। ১৭. বন্যাকবলিত মানুষ যাতে সুপেয় পানি পায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ১৯. বন্যার পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কতামূলক অবস্থা আরও দ্রুত শক্তিশালী ও আধুনিক করা। ২০. বন্যার্ত মানুষের সহায়তায় দক্ষ, সৎ ও একনিষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবী, কর্মী ও ব্যবস্থাপক নিয়োগ দিতে হবে। ২১. পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে আরও কার্যকরী ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আবদুল আলীম নোবেল : সমন্বয়ক, পরিকল্পিত কক্সবাজার আন্দোলন।
মুঠোফোন : ০১৮২৪-৪০৩০৮৩, ই-মেইল : coxproud@gmail.com