প্রথম আলো:
এডিস মশা যে তিনটি রোগ ছড়ায়, তার সব কটিই বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ঢাকায়। ২০০৮ সালে চিকুনগুনিয়া রাজশাহীর পবায় এবং ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে জিকা শনাক্ত হয়। গত ২৮ বছরে এই তিনটি রোগসহ দেশে মোট সাতটি নতুন রোগ শনাক্ত হয়েছে।

বাকি চারটি হলো এইচআইভি/এইডস, নিপাহ, বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সোয়াইন ফ্লু। যেসব রোগ কখনোই মানুষের ছিল না এবং তা যদি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়, তখন তাকে নতুন রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে এমন রোগ স্বাস্থ্য অর্থনীতিতে একটা বড় চাপ সৃষ্টি করছে।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার জ্যেষ্ঠ কারিগরি পরামর্শক নিতীশ দেবনাথ নতুন রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পরিবেশের অবনতি এবং নিবিড় পশুপাখি ও মাছ চাষের কারণে নতুন নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী পর্যটন, অভিবাসন এবং অবাধ বাণিজ্যের কারণে মানুষ থেকে মানুষে রোগ দ্রুত ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, আজ যা পশুর রোগ, ভবিষ্যতে তা মানুষের রোগ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

নতুন সাত রোগ
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। ২০০০ সালে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর এর ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা নিয়ে হিমশিম খান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চিকিৎসকেরা। রোগের কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা বুঝে ওঠার আগেই অনেক রোগীর মৃত্যু ঘটে। ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে এক শর মতো মানুষের মৃত্যু হয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধি, দ্রুত রোগ শনাক্ত ও সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগের পর ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে থাকে। তবে এখনো এই রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে। গত বছর ১৪ জন মারা গেছে। এ বছর এ পর্যন্ত ২ জন মারা গেছে।

এ বছর এপ্রিল-মে থেকে ঢাকা শহরে চিকুনগুনিয়া মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে। ২০০৮ সালে রাজশাহীর পবায় চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হওয়ার পর ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। পরের বছর টাঙ্গাইলের পালপাড়ায় এই রোগ দেখা দেয়। তবে মাঝেমধ্যে এই রোগ চিকিৎসকদের নজরে পড়ে। গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকা শহরের কাঁঠালবাগান এলাকায় ৩০ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।

ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশে জিকা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লেও বাংলাদেশে এখনো তেমন কোনো নজির দেখা যায়নি। চট্টগ্রামের একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২০১৪ সালে। এটা শনাক্ত করেছিল আইইডিসিআর। তবে ওই ব্যক্তি কোথায় কীভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে রোগটি নিয়ে সরকার সতর্ক আছে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী একাধিক সভায় উল্লেখ করেছেন।

ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া বা জিকাই শুধু নতুন রোগ নয়। ২০০১ সালে নিপাহ, ২০০৭ সালে বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত মানুষ প্রথম শনাক্ত হয়।

নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মাঝেমধ্যে দু-একজনের মৃত্যু হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে আইইডিসিআর। ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও জেলায় নিপাহর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর লালমনিরহাট, রাজবাড়ী এবং ফরিদপুর জেলায় এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বাদুড় খেজুরের রসে মুখ দিয়ে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়, সেই রস মানুষ খেলে এতে আক্রান্ত হয়।

বার্ড ফ্লু নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল প্রথমত পোলট্রি শিল্পের মালিকদের। অনেক খামারে এই রোগ দেখা দেয়। সরকার এই শিল্পকে বাঁচাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এই রোগ একসময় মানুষের মধ্যেও ছড়ায়। একাধিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।

দেশে বড় ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের পর। এ রোগটিও দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে এ পর্যন্ত ছয়জন মারা গেছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর সূত্র। এই রোগ চিকিৎসার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বিপুল পরিমাণ ওষুধ দেওয়া হয়েছিল।

তবে বাইরে থেকে আসা রোগের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে এইচআইভি/এইডস নিয়ে। ১৯৮৯ সালে একজন বিদেশি এবং ১৯৯০ সালে দুজন দেশি এইডস রোগী শনাক্ত হয়। প্রতিবছর এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর এই রোগে ১৪১ জন মারা গেছে। এ ছাড়া শিরায় মাদক নেয় এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই রোগের প্রকোপ অনেক বেশি।

মাঝেমধ্যে এ রকম নতুন রোগের কথা শোনা যায়। তবে এটা যে শুধু বাংলাদেশে ঘটছে, তা নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ২০০৫ সালের এক গবেষণা প্রবন্ধে বলেছিল, ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি আট মাসে একটি নতুন রোগ মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ১৯৮০ সালকে বেছে নেওয়া হয়েছিল এই কারণে যে ওই বছর পৃথিবীকে গুটি বসন্তমুক্ত ঘোষণা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বলছে, বর্তমানে নতুন যেসব রোগ দেখা যাচ্ছে, তার ৭০ শতাংশ পশুপাখি থেকে আসছে। সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, নিপাহ ভাইরাস আসে পশুপাখি থেকে। মানুষ, প্রাণী ও প্রতিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার কারণে এসবের উৎপত্তি হচ্ছে। একই সঙ্গে মানুষ ও পশুপাখির ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসব রোগের বিস্তার বেশি।

মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে ‘অজ্ঞাত রোগে’ মানুষ আক্রান্ত—এমন খবর বের হয়। কিছু ক্ষেত্রে রোগ শনাক্ত করতে বিলম্ব হয়। যেমন সম্প্রতি হামে আক্রান্ত হয়ে সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরাপাড়ায় ৯ শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং ৮৫টি শিশু হাসপাতালে ভর্তি ছিল। প্রথমে বলা হয়েছিল, এরা ‘অজ্ঞাত রোগে’ আক্রান্ত। কিছু ক্ষেত্রে গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত এক ব্যক্তি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি, এমন কথা শোনা যায়। একই বছর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মার্স করোনারি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ভর্তি আছে, এমন শোনা যায়। দুটি ঘটনাই অনুসন্ধান করে আইইডিসিআর। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, দুটিই ছিল গুজব।

আবার পুরোনো কিছু রোগ নতুনভাবেও দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে অ্যানথ্রাক্স একটি। ২০০৯ সাল থেকে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় মানুষ নিয়মিতভাবে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হচ্ছে।

যক্ষ্মা পুরোনো রোগ হলেও ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর-টিবি ও এক্সডিআর-টিবি) নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ২০০২ সালে প্রথম ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়।

করণীয় কী

নতুন নতুন রোগ দেখা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ ও পশুপাখির স্বাস্থ্যকে আর আলাদা করে দেখার প্রয়োজন নেই বলে অনেকেই মনে করছেন। ‘ওয়ান হেলথ’ বা ‘এক স্বাস্থ্য’ নামে আন্দোলন বা ধারণাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্বব্যাপী এগিয়ে নিচ্ছে। সংস্থা দুটির যৌথ কার্যক্রম হলো ‘ওয়ান হেলথ’। আইইডিসিআরে এ বিষয়ে গবেষণাগার আছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগের ওপর নজরদারির ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। জনস্বাস্থ্যবিদ, পশুস্বাস্থ্যবিদ, কৃষিবিদ, পরিবেশবিদ একসঙ্গে নজরদারিতে অংশ নিতে হবে। স্বাস্থ্য এখন শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়।

কোনো একটি বিশেষ রোগের ক্ষেত্রে তিনটি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। অন্য কোনো দেশ থেকে রোগ আসার আশঙ্কা থাকলে আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে রোগ শনাক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের মধ্যে রোগ শনাক্ত হলে রোগের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্রুত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে।

‘ওয়ান হেলথ’ কার্যক্রম বাংলাদেশে শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা। তিনি বলেন, নতুন রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলে বন্দরগুলোতে রোগ শনাক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। জিকা ও ইবোলার জন্য এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সোয়াইন ফ্লুর জন্যও নেওয়া হয়েছিল। নতুন রোগ শনাক্ত হলে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়া নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে কি না বা বিশেষ কোনো রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে কি না, তা বছরজুড়ে নজরদারি করারও ব্যবস্থা আছে।