বিশেষ প্রতিবেদক:
দাগী সন্ত্রাসীদের বিচরণ আর প্রভাব বিস্তারের কারণে মহেশখালীর ক্রাইমজোন হোয়ানকের কেরুনতলীতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে সাধারণ মানুষের প্রাণের নিরাপত্তাসহ জীবন যাপন পর্যন্ত হুমকিতে রয়েছে। সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আতঙ্কে দিন কাটছে এসব মানুষের। মহেশখালীর থানায় ওসি প্রদীপ কুমার পর থেকে কিছু সন্ত্রাসী এলাকায় ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তবে অধিকাংশই পাশের পাহাড়ি এলাকায় ঘাঁটি গড়েছে। সুযোগ বুঝে সেখান থেকে বের হয়ে লোকালয়ে তান্ডব চালিয়ে আবার আত্মগোপনে চলে যায়। এসব সন্ত্রাসীদের জবর দখল ও চাঁদাবাজির কারণে বর্তমানে চিংড়িঘের মালিকেরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে কেরুনতলীতে প্রায় শতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বিচরণ করছে। তার মধ্যে শীর্ষ তালিকায় কোদাইল্যার গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরা। এই কোদাইল্যার গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে ওমর আলীর পুত্র মো. ইসমাইল। আরো রয়েছে ইসমাঈলে ছোট ভাই লালাই্যা, মেহের আলীর পুত্র আনচার। এই বাহিনী ইসমাঈল বাহিনী নামে পরিচিত। এছাড়া কোদাইল্যার গোষ্ঠীর এই সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথে আরো অন্তত ৩০জন ভয়ংকর সন্ত্রাসী। এই বাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে কেরুনতলী হিন্দু পাড়া আরেক দাগী সন্ত্রাসী স্বপন ও শহিদুল্লাহর পুত্র ইমাম হোসেন প্রকাশ মিন্টু। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার পলাতক আরো ২০ জনের বেশি সন্ত্রাসী এই বাহিনীর সাথে রয়েছে। এই বাহিনী এতই ভয়ংকর যে তারা পথ হাঁটলে সাধারণ লোকজন ভয়ে অনেক দূরে সরে যায়। এই বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমে চিংড়ি ও লবণ ঘের দখল এবং পাহাড়ে পানের বরজ, বাগান দখল, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, অপহরণসহ নানা অপরাধ ঘটাচ্ছে। তাদের ভয়ে সাধারণ লোকজন মুখ খুলতে পারে না। গোলাম আযমের সাবেক দেহরক্ষী আকতার হামিদই এই বাহিনীর গড়ফাদার। তার কথা মতো কাজ করে ইসমাঈল বাহিনী। মূলত আকতার হামিদের ভাড়াটে হিসেবে সব অপরাধ কর্মকা- ঘটায় ইসমাঈল বাহিনী।
অন্যদিকে ইসমাঈল বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্লা দিয়ে কেরুনতলীতে আরো দু’টি সন্ত্রাসী বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই দু’বাহিনীর একটি হচ্ছে গুরাবাশি-আহসান উল্লাহ বাহিনী। অপরটি হচ্ছে আলম বাহিনী। গুরাবাশি-আহসান উল্লাহ বাহিনীতে ১০ জনের বেশি দাগী সন্ত্রাসী রয়েছে। গুরাবাশি ও আহসান উল্লাহর পরে দুই জসিম, নুনাইয়া (কারান্তরীণ) বেশি ভয়ংকর। মৃত বক্সু মেম্বারের পুত্র সাজাপ্রাপ্ত আসামী সন্ত্রাসী আলমের নেতৃত্বাধীন আলম বাহিনীতে রয়েছে আলম ছাড়াও তার মামাতো ভাই আবছার, আমিন, বদসহ আরো ১৫ জনের বেশি সন্ত্রাসী। তবে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে গুরাবাশি-আহসান উল্লাহ বাহিনী ও আলম বাহিনী এক জোট। তারা ইসমাঈল বাহিনীকে হটাতে মরিয়া।
জানা গেছে, মহেশখালী থানায় যোগ দিয়ে বর্তমান ওসি প্রদীপ কুমার উপজেলা জুড়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অ্যাকশন শুরু করে। ওসির এই অ্যাকশানের ভয়ে কৌশল বদলালেও কেরুনতলীর সন্ত্রাসীরা দমেনি। তারা প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে না পারলেও সুযোগ বুঝে নানা সন্ত্রাসী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যে লবণ মৌসুমে সাধারণ লোকজনের লবণ ঘের দখল করে লুটপাট শুরু করে। তবে পুলিশের অ্যাকশনের মুখে তারা স্থায়ী হতে পারেনি। এই নিয়ে পুলিশ ইসমাঈল বাহিনীসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীদের অনেক পাকড়াও করেছিল। ওই সময় পুলিশের সাথে সন্ত্রাসীদের কয়েকবার বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাও ঘটে। এক বন্দুকযুদ্ধে আকতার বাহিনীর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কমান্ডার খ্যাত আবদু সাত্তার নিহত হন। গত ফেব্রুয়ারিতে এই ঘটনা ঘটে। নিহত সাত্তার হোয়ানক মাঝেরপাড়ার নূরচ্ছফার পুত্র। তার বিরুদ্ধে একটি নারী নির্যাতন ও তিনটি অস্ত্র মামলাসহ মহেশখালী থানায় ছয়টি মামলা রয়েছে (মামলা নং-৩২/২০১৩, ১৫/২০০৫, ৩১/২০১৫, ৯/২০১৫, ৩৬/২০১৭, ৩৭/১৭)। এসব বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
পুলিশ জানিয়ে, নিহত সন্ত্রাসী সাত্তার গোলাম আযমের দেহরক্ষী আকতার হামিদের লালিত বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। শুধু তাই নয়; সে অস্ত্র ব্যবসার সাথেও জড়িত ছিলো। আকতার হামিদের সকল অস্ত্রের যোগান সাত্তার দিতো বলে পুলিশ দাবি করেছেন। এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়াও করতো সাত্তার। আকতার হামিদের হয়ে লবণ মাঠ, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চিংড়িঘের দখলসহ যাবতীয় সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অগ্রভাগে থাকতো সাত্তার।
সূত্র মতে, পুলিশের নিরাপত্তার মুখে লবণ চাষীরা সুষ্ঠুভাবে লবণ মাঠ মৌসুম সম্পন্ন করতে পেরেছে। কিন্তু বর্তমানে চিংড়ি মৌসুম শুরু হওয়ায় সন্ত্রাসীরা আবার মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে। সন্ত্রাসীরা আবারো চিংড়ি ঘের জবর দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আকতার হামিদের নিয়ন্ত্রণাধীন ইসমাঈল বাহিনী বর্তমানে চিংড়ি ঘের মালিকদের অব্যাহত ভাবে হুমকি দিচ্ছে। চিংড়িঘের দখল করতে এই সন্ত্রাসী বাহিনী ভাড়াটে সন্ত্রাসী ও ভারী অস্ত্র মজুদ করেছে প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে।
পেছনের কাহিনী: স্থানীয় লোকজন জানান, কেরুনতলী এক সময় শান্ত এলাকা ছিলো। বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলে গোলাম আযমের দেহরক্ষী ও স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান মৃত আবদুল মাবুদের পুত্র আকতার হামিদ ক্ষমতার প্রভাব কাটিয়ে এলাকার সাধারণ মানুষের লবণ মাঠ ও চিংড়িঘের দখল শুরু করে। প্রথমে হেতালিয়া ঘোনা দখল করে। এক পর্যায়ে প্রায় ১০টি ঘোনা দখল করে নেয়। এসব দখল পোক্ত করতে নানা প্রলোভনে এলাকা শিক্ষিতসহ বেশকিছু যুবক নিয়ে গড়ে তোলে সন্ত্রাসী বাহিনী। তার জন্য মজুদ করা হয় একে-৪৭সহ বিপুল ভারী অস্ত্র। আস্তে আস্তে প্রলোভনে ফেলে এলাকার যুবকদের সন্তাসী বাহিনীতে ভেড়াতে থাকে। এক পর্যায়ে দেখা যায় অধিকাংশ যুবক আকতার হামিদের সন্ত্রাসী বাহিনীতে জড়িয়ে পড়ে। এতে এলাকায় চরম নৈরাজ্য ও নৈতিক অধ:পতন শুরু হয়। নানা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পুরো এলাকা ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে পিতা-পুত্রসহ দুজনকে হত্যা করে আকতার হামিদের সন্ত্রাসীরা। তারা হলেন সাবেক মেম্বার মো. বক্সু তার পুত্র জয়নাল আবেদনী। এছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি ভয়ংকর সন্ত্রাসীমুলক ঘটনা ঘটায় তার বাহিনী। হত্যাসহ এসব ঘটনায় আকতার হামিদের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা রয়েছে। একই সাথে তার ভাই শাহজাহান, এনামসহ অন্যদের বিরুদ্ধেও ১০টির বেশি মামলা রয়েছে।
এদিকে এক পর্যায়ে নানা মত বিরোধের প্রথম দিকে গড়ে তোলা সন্ত্রাসীরা আকতার হামিদের কাছ থেকে সরে পড়ে। এতে আবার নতুন করে সন্ত্রাসী বানায় যুবকদের। এভাবে অন্তত চারটি প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয় আকতার হামিদ। র‌্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়ার থেকে আত্মগোপনে চলে গেছে। কিন্তু আত্মগোপণে গেলেও আস্তানায় বসে বাহিনীর সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে আকতার হামিদ। এখন পর্যন্ত তার লালিত সন্ত্রাসীদের দাপটে কেরুনতলী অস্থির হয়ে আছে।
সার্বিক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ‘আমি মহেশখালীতে যোগদান করার পর কয়েকটি সন্ত্রাসী এলাকা কথা জানতে পারি। তার মধ্যে প্রধান হলো কেরুনতলী। তাই সন্ত্রাসীদের নির্মূলে কেরুনতলীতে সাড়াশি অভিযান জোরদার করি। এতে সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপর ক্ষেপে যায়। ক্ষেপে গিয়ে তারা বেশ কয়েকবার পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছে। এতে সৃষ্ট বন্দুকযুদ্ধে সাত্তার নামে এক সন্ত্রাসী নিহতও হয়েছে।’
ওসি বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা যতই শক্তিশালী হোক আমি ছাড় দেবো না। আমি শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান চালিয়ে যাবো।’