সিবিএন ডেস্ক:
শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দিয়ে কার্ড প্রকাশ করে বিপাকে পড়েছেন বরগুনার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারেক সালমান। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রের পেছনের দিকে বঙ্গবন্ধুর ছবি যুক্ত করায় জাতির মানহানি হয়েছে, এমন অভিযোগে গত ৭ জুন একটি মামলার সমনের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। বুধবার (১৯ জুলাই) প্রথমে তার জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলেও পরে তাকে জামিন দেন আদালত।
জামিনে বেরিয়ে ইউএনও সালমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কাগজে-কলমে বরিশাল আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়দুল্লাহ সাজু মামলার বাদী হলেও আমার মনে হয়, কেউ তাকে দিয়ে এটি করিয়েছে। এর সঙ্গে এমন কেউ জড়িত যিনি আমি আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকালে অসন্তুষ্ট ছিলেন কিংবা আমার কারণে যার স্বার্থে আঘাত লেগেছিল।’
কিন্তু ওই ব্যক্তি কে বা কী ধরনের স্বার্থ নিয়ে সংঘাত হয়েছিল তা নিয়ে কথা বলতে রাজি নন বরগুনায় বদলি হওয়া এই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ক্লাস ফাইভের শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর চিত্রকর্ম দিয়ে স্বাধীনতা দিবসের কার্ড বানানোর মধ্য দিয়ে কিভাবে অবমাননা হয় সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তার কথায়, ‘আমি হয়তো আন্দাজ করছি, কিন্তু বলা যাবে না। তবে এটা বলতে পারি, আগৈলঝাড়া থেকে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরির মাধ্যমে আমাকে সরানো হয়েছে।’
এদিকে অভিযোগকারীআইনজীবী ওবায়দুল্লাহ সাজু দাবি, বঙ্গবন্ধুর ছবির বিকৃতি ঘটেছে বলে মামলাটি তিনি নিজেই করেছেন। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া তার বক্তব্য হলো, ‘যে ছবি দিয়ে কার্ড বানানো হয়েছে সেখানে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা ঘটেছে মনে করায় মামলা করেছি।’
যদিও ইউএনও তারেক জানান, ঘোষণা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানকারীদের আঁকা চিত্রকর্ম ব্যবহার করে কার্ড বানানোর কথা। বঙ্গবন্ধুর ওই ছবিটি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়। সেটি কার্ডের সামনের ভাগে রাখা হলেও এর ওপরে বেশকিছু লেখা পড়ে খারাপ উপস্থাপন হবে ভেবে ব্যাককাভারের জন্য দেওয়া হয়। এতে অবমাননা ঘটেছে এবং প্রতিকৃতি বিকৃত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়। যদিও সেই শিক্ষার্থী যেমন এঁকেছেন তেমনই দেওয়া হয়েছে। কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি।

স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্রে জাতির জনকের ছবি ‘বিকৃতি ও অবমাননা’র অভিযোগে ইউএনও সালমানের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও ‘আসল কারণ’ কী তা নিয়ে মুখ খুলছেন না কেউ। তিনিও সত্যি বলতে কেন ভয় পাচ্ছেন তা নিয়ে কথা না বললেও তার পরিবারের সদস্যদের দাবি, ‘এই কার্ডকে ইস্যু বানানো হচ্ছে। এর পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে।’

এদিকে বাদী আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়দুল্লাহ সাজু বলেন, ‘জামিনযোগ্য ধারার মামলা হওয়ায় আদালত জামিন দিয়েছেন।’ সকালে জামিন চাইলে তা নাকচ হয় প্রসঙ্গ টেনে আনলে তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে দ্বিতীয় আবেদনের সময় প্রশাসন থেকে কেউ কিছু বলে থাকতে পারে।’ এরপরই তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন। তারপর থেকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আর তার মোবাইল ফোন চালু পাওয়া যায়নি।

চিত্রাঙ্গনের শিক্ষকরা বলছেন, শিশুর হাতে আঁকা চিত্রকর্ম কখনও নিখুঁত হবে না। এজন্য জেল-জরিমানা করা বাড়াবাড়ি। এ ধরনের আয়োজন শিশুদের উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে জাতির জনকের বিষয়ে জানানোর উদ্যোগ। এখানে কিভাবে মানহানির বিষয়টি এলো সেই প্রশ্ন তুলেছেন খোদ আইনজীবীরা। তাদের মতে, ‘ক্ষমতাবানদের অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য এসব করা হয়ে থাকে, এটা একেবারেই কাম্য নয়। শিশুর আঁকায় কোনও দোষ থাকতে পারে না।’

এমন ঘটনায় মামলা ও জরিমানা হওয়া বাড়াবাড়ি বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন আহমেদ। ইউএনও’র কোনও ভুল হয়ে থাকলে তার জন্য বিভাগীয় শোকজই যথেষ্ট ছিল বলে মনে করেন তিনি। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া তার বক্তব্য হলো— ‘মানহানি মামলার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি চর্চা বাধাগ্রস্ত হবে। এসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতির পিতাকে জানবে শিশুরা। কিন্তু মামলা বা বাধা সৃষ্টি করা হলে তা ভীতিকর হয়ে দাঁড়ায় এবং এর প্রতিক্রিয়া ভালো হয় না।’

চারুকলা অনুষদের এই অধ্যাপক আরও বলেছেন, ‘ছবিটি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়েছে নির্দোষ শিশুর হাতে আঁকা ছবি। এই ছবিকে পুরস্কার দেওয়া এবং এই ছবি দিয়ে কার্ড বানিয়ে থাকলে কোনও অপরাধ হয়েছে বলে মনে করি না। কারও অনুগ্রহ পেতে আলোচনা-সমালোচনায় আসার জন্য এ ধরনের মামলা করার প্রবণতা থাকে। এটি কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। ক্লাস ফাইভের শিশু নিপুণভাবে আঁকবে তা আশা করা ঠিক না। সে তার মতো আঁকবে, সেই আঁকা যারা ব্যবহার করবেন আইনগত বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে তাদের।’

বরিশালের আইনজীবী সমিতির সভাপতি বাদী হয়ে গত ৭ জুন তৎকালীন আগৈলঝাড়ার ইউএনও এবং বর্তমানে বরগুনার ইউএনও গাজী তারেক সালমানের বিরুদ্ধে বরিশাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেন। ওইদিন মামলা আমলে নিয়ে আদালতের বিচারক ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে তাকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সমন জারির আদেশ দেন। বুধবার আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে প্রথমে তা নাকচ হলেও দ্বিতীয়বারে তার জামিন মঞ্জুর হয়।

-বাংলা ট্রিবিউন