সেলিম উদ্দিন, ঈদগাঁও (কক্সবাজার) :

কক্সবাজার সদর উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের গোমাতলীর ১০ গ্রামের ২০ হাজার মানুষ র্দীঘ ১৪ মাস ধরে পানিবন্দি। ইউনিয়নের র্পূব-পশ্চিম-উত্তর গোমাতলীর প্রায় ৫টি গ্রামে সুপেয় পানি ও ওষুধের জন্য হাহাকার চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি গ্রামে কেউ ত্রাণের দেখা পাননি। যেখানে পৌঁছেছে, সেখানেও চাহিদার তুলনায় পরিমাণ অপ্রতুল। সামান্য পরিমাণে ত্রাণের চাল পেলেও তা চারদিক পানিতে ডুবে যাওয়ায় রান্না করার মতো শুকনো স্থান নেই। ফলে অনেকেরই অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে। ক্ষুধার জ্বালায় বানভাসী মানুষ ত্রাণের নৌকা দেখলেই পানি ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পরিমাণ অল্প হওয়ায় সবার হাতে পৌঁছায় না খাদ্যসামগ্রী। ফলে অনেকেই ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছেন শূন্য হাতে। এ অবস্থায় সরকারি ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ত্রাণের জন্য ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা স্বজনপ্রীতি করছেন বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই।

অপরদিকে পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় বিপুলসংখ্যক গৃহহীন মানুষ বিভিন্ন উঁচু জায়গায় খোলা আকাশের নিচে গবাদি পশুর সঙ্গে রাত যাপন করছেন। সব মিলিয়ে গোমাতলীর বানভাসি মানুষ ভালো নেই। তারা জানেন না কবে নাগাদ পাউবো বেড়িবাঁধ সংস্কার করে আগের জীবনে ফিরবে। তাদের কাছে প্রতিটি দিন যেমন, তেমনই রাতও পাথরের মতো ভারি মনে হচ্ছে। একটি রাত যেন কয়েক দিনের মতো লম্বা সময় নিয়ে পার হচ্ছে। যার কারনে গোমাতলীর বানভাসি মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে অজানা আতঙ্ক।

রোয়ানু-মোরায় বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন কবলিত এলাকা সরজমিন পরিদর্শনে গেলে কথা হয় মাষ্টার আয়ুব আলীর সাথে তিনি বলেন, ৬ নং স্লুইচের বেড়িবাঁধ ভাঙনে এখানকার ১ হাজার পরিবার গৃহহারা হয়। তখন কেউ রাস্তার ধারে, আবার কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করি। ওই সময় সরকারী-বেসরকারীভাবে আমাদের ত্রাণ দেয়া হয়। তাও যথেষ্ট নয়। সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের লোকজন অমুক করে দেব, তমুক করে দেব বলে চলে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয়না। আমরা ত্রাণ চাই না, চাই গোমাতলীতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ, স্থায়ী সমাধান।

এক তথ্যনুসন্ধ্যানে বলা হচ্ছে, রোয়ানু-মোরা জলোচ্ছাসে বৃহত্তর গোমাতলীর ক্ষতিগ্রস্থের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার পরিবার। ক্ষতিগ্রস্থ এসব মানুষের জন্য কয়েক টন চাল, নগদ কিছু অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি শুকনো খাবারের প্যাকেটও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বরাদ্দের সঙ্গে বিতরণের কোনো মিল নেই। যে কারণে বানভাসী মানুষ চাহিদা অনুযায়ী ত্রাণ পাচ্ছেন না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই জানান, চাহিদা অনুযায়ী তারা ত্রাণ পাচ্ছেন না। ফলে বানভাসী মানুষকে তারা তেমন কিছু দিতে পারছেন না। আশ্রয় কেন্দ্র, বা স্থানীয় স্কুলে আশ্রয় নেয়া মানুষ খেয়ে-না খেয়ে দিন পার করছেন।

সূত্রে জানা গেছে, গোমাতলীর ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। প্রতিদিনের জোয়ার ভাটায় ইউনিয়নের ২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তর গোমাতলী মোহাজের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম র্দীঘদিন ধরে বন্দ রয়েছে। ঐ এলাকার আজিম পাড়া গ্রামের গৃহিণী জুলেখা খাতুন জানান, বাড়িতে পানি ওঠায় নোনা পানিতে হাত-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে। চরম কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন তারা।

বানভাসীদের অভিযোগ, তারা পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না। পাশাপাশি গবাদি পশুর খাবার জোগাতে না পেরে অনেকে কমমূল্যে তাদের গরু-ছাগল বিক্রি করে দিচ্ছেন। ইউনিয়নের উত্তর গোমাতলী চর পাড়া গ্রামের আবদুল গাফ্ফার (৬০) বলেন, জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় রান্না করার কোনো উপায় নেই। গত ক’দিন কাজ না পেয়ে ৫ দিন থেকে ভাত কি জিনিস দেখিনি। তিনি আরো বলেন, কাজ করে খাই। জোয়ারের পানির কারণে ২ সপ্তাহ ধরে বাড়ি থেকে বের হতে পারছিনা।

ত্রাণ স্বল্পতার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পোকখালীর জন্য পর্যাপ্ত চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক বলেন, গোমাতলীতে ২ দফা জলোচ্ছাসে ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় ২০ হাজার লোক মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের অভিযোগ, ত্রাণসামগ্রী চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল এবং ইউনিয়নের কোনো কোনো এলাকায় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিতরণে অনিয়ম করছেন।

ত্রাণের অপ্রতুলতার বিষয়ে পোকখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিক আহমদ বলেন, এই ইউনিয়নের ৭/৮ও ৯ নং ওয়ার্ডের ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। অথচ চাল এবং নগদ অর্থ পাওয়া গেছে চাহিদার তুলনায় একদম কম। সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ছে।

জনপ্রতিনিধিদের এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো:আলী হোসেন বলেন, ত্রাণের কোনো অভাব নেই। এ পর্যন্ত বন্যার্তদের মাঝে পর্যাপ্ত পরিমান চাল এবং নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া শুকনা খাবারও বিতরণ করা হয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও বরাদ্দ দেয়া হবে।

গত শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বানভাসীদের দুর্ভোগ দেখা যায়। অন্তত ২ হাজার পরিবার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। ঘরে ঘরে বিরাজ করছে শুকনা ও শিশু খাবারের সংকট। সরকারিভাবে ত্রাণ অপ্রতুল হওয়ায় সবার ভাগ্যে জোটেনি এখনও। এসব দুর্গত মানুষের পাশে এখন পর্যন্ত দাঁড়ায়নি কোনো এনজিও। ফলে বন্যা দুর্গত মানুষরা এখন চরম সংকটে।

পোকখালী ইউনিয়নের গোমাতলীতে এবারে সবচেয়ে বেশী ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ। জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। অনেকগুলো ভাঙ্গা দিয়ে এখনও লোকালয়ে জোয়ার ভাটার পানি উঠা নামা চলছে। এতে এ বর্ষা মৌসুমে চিংড়ি চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সাবিবুর রহমান জানান; কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৬৬/৩ নং পোল্ডারের গোমাতলী এলাকায় প্রায় ৫শ’ মিটার বেড়িবাঁধ ব্যাপক ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গা দিয়ে সাগরের নুনা পানি ঢুকে উপকুলীয় গোমাতলীর ১০টি গ্রাম প্লাাবিত হয়েছে। এখনও ওই ভাঙ্গা দিয়ে লোকালয়ে জোয়ার ভাটার পানি উঠা নামা করছে। তিনি জরুরী বরাদ্দ দিয়ে বেড়িবাঁধের সব ভাঙনগুলো পুনঃনির্মাণ করার জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে বলে জানান।