সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
হিসাব শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নন এমন বাংলাভাষী মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এদের মধ্যে যারা প্রকৃতই হিসাব বুঝেন তারা তর তর করে উপরে উঠে যান। আর যারা হিসাব বুঝেন না তাদের পতন অনিবার্য। অনেকটা শ্লেষাত্মক অর্থেই তাদের বেহিসাবী বলা হয়।
নিকাশ শব্দটির সঙ্গেও বাংলাভাষী মানুষ পরিচিত। তবে আলাদা করে নিকাশের ব্যবহার খুব সীমিত। নিকাশ শব্দটি হিসাবের সঙ্গে যোগ করে হিসাব-নিকাশ একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়। বাংলা একাডেমী প্রণীত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে নিকাশ শব্দের অনেকগুলো অর্থ দেয়া আছে। এগুলো হল চুড়ান্ত হিসাব, বের হওয়া, নির্গমন, সমাপন শেষ, অবসান, বধ ও ধ্বংস। এই শব্দটি দেশের বর্তমান রাজনীতি ও আগামী বছরের নির্বাচনের রাজনীতির জন্য ঘটনাক্রমে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
বিকাশ শব্দটির আভিধানিক অর্থ প্রকাশ, ব্যক্তকরণ, উন্মেষ প্রসার ও উন্নতি। এসব অর্থকে ছাপিয়ে বিকাশ শব্দটিকে জনপ্রিয় করেছে বেসরকারী সংস্থা ও বহুজাতিক কোম্পানী ব্র্যাক। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিকাশ শব্দটি এখন ব্যাংকের চাইতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষকে লেনদেনের জন্য ব্যাংকে যেতে হয়। এক্ষেত্রে বিকাশ ধারণার মাধ্যমে ব্যাংকই এখন উল্টো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের পর থেকে বিকাশ শব্দটি ব্যাঙ্গাত্মক অর্থেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঐ নির্বাচনে ১৫৩ জন সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে বিরোধী দল, নিন্দুক, সরকারের সমালোচকরা এসব সম্মানিত সাংসদগণকে বিকাশ এমপি বলে অভিহিত করতে কুন্ঠাবোধ করছেন না। ফলে বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিকাশ শব্দটিও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে? বিএনপি চেয়ারপার্সনের ভাষায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে? নির্বাচনে সরকার কি আবার ২০১৪ সনের পূনরাবৃত্তি করবে?
ঐ নির্বাচনের মাধ্যমে কি সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গঠিত হবে? এসব প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের কাছে থেকে উঠে এসেছে। এই কারণেই আগামী নির্বাচন কি “হিসাবের নির্বাচন” হবে নাকি “বিকাশের নির্বাচন” হবে এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। যদি হিসাবের নির্বাচন না হয়ে আবারও বিকাশের নির্বাচন হয় তাহলে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র, সাংবিধানিক অধিকার, মুক্তিবুদ্ধি ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির নিকাশ বা ধ্বংস হবে কিনা এটাও দেখার বিষয়। অবশ্য ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল একে অপরকে ধ্বংস বা নিকাশ করতে পারবে এখন বিশ্বাস ধারণ করে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে।
নির্বাচনের ঘোষণা আসার পর থেকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এমন ঘোষণা আসার পর থেকে আগামী নির্বাচনটি বিকাশ নয় হিসাবের নির্বাচন হবে এমন ধারণা জনমনে বদ্ধমূল হয়েছে। তবে আগামী নির্বাচনে কার নিকাশ বা ধ্বংস হবে তা সময়ই বলে দেবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসাবে ব্যাপক সাংগঠিক কার্যক্রম ঘোষণা করেছে। কিন্তু মাঠে পরিস্থিতি ভিন্ন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে বিদেশে বিপুল ভাবমূর্তি অর্জন করলেও দলের জেলা পর্যায়ের নেতারা এখন পর্যন্ত ‘ভাবের’ মধ্যেই আছেন। অধিংকাশ জেলার নেতা ও সাংসদের উপর তৃণমূল কর্মীরা ক্ষুব্ধ। তাদের জনপ্রিয়তাতো নেই। সংসদীয় আসনে সাধারণ জনগণও ক্ষুব্ধ। ক্ষুব্ধ তাদের পরিবারের সদস্যরাও। এর উপর নতুন যন্ত্রণা যোগ হয়েছে হাইব্রিড ও মৌসুমী নেতাদের উপদ্রব। তাদের দাপটে আসল কর্মীরা দলীয় অফিস তো দুরের কথা সামাজিক অনুষ্ঠানেও দলের নেতাদের সামনে পড়তে চাননা।
জেলায় জেলায় নেতাদের স্বজনপ্রীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিভিন্ন সাংগঠনিক ইউনিটে নিজের আপন ভাই, পুত্র, জামাত বিএনপি থেকে সদ্য যোগদানকারীদের স্থান দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের অবজ্ঞা এবং অপমান করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের অনেকেই বলছেন দল আবার বিরোধী দলে গেলে হাইব্রিড ও সুবিধাবাদীরা সরে পড়বে এবং তখন তাদের আবার ডেকে পাঠানো হবে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী অধিকাংশ নেতাই এই ধারণা পোষন করেন যে ২০১৮ সালে কোন ক্রেডিবল ভোট হবেনা। প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে শেখ হাসিনা তাদের এমপি বানিয়ে দেবেন। নির্বাচন করে এমপি হওয়ার চাইতে বিকাশ এমপি হওয়ার দিকেই তাঁদের ঝোঁক বেশী।
নির্বাচনে দলকে জিতিয়ে আনার পরিবর্তে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি দখল, এলাকার আধিপত্য বিস্তার, চিংড়ি ঘের দখল-বেদখলকে ঘিরে একে অপরকে ঘায়েল করতে ব্যস্ত।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাম্প্রতিককালে কয়েকটি জেলা সফরকালে দলের নেতাদের একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপের ধরন দেখে হতবাক হয়েছেন।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের বাজেট, চালের দাম এবং সরকার ঘোষিত উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে অর্থায়নে সংকট, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার আওয়ামী লীগর হিসাবের রাজনীতিতে বড় আশংকা তৈরী হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একজন নীতি নির্ধারণ জানান সরকার আর কোন বিকাশ মার্কা নির্বাচন চাননা। তারা চান একটি ক্রেডিবল নির্বাচন। তাদের অভিমত সরকারের অর্জিত সাফল্যগুলো তুলে ধরে গ্রহণযোগ্য। দুর্নীতিমুক্ত প্রার্থী মনোনয়ন দিলেই বিএনপির প্রার্থীরা ধরাশায়ী হবে। এবং আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোটেই সরকার গঠন করবে।
এদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জেলা পর্যায়ের নেতারা বেশ খোশমেজাজে আছেন। বেশীরভাগ জেলাতেই নেতাদের আন্ত:কোন্দল এখন অনেকটা প্রশমিত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান বিএনপি এখন সাংগঠনিকভাবে শক্ত অবস্থানে আছে। দলে কারা নেতৃত্ব দিবে কারা নির্বাচন করবে এই বিষয়টি তারা সুরাহা করার চেষ্টা করছেন। তবে বড় মাঝারী সারী ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের আন্দোলন বিম্নুখ অবস্থা নিয়ে তারা এখনও চিন্তিত। তবে দলের নেতারা নির্বাচনমুখী হলে তৃণমূল কর্মীরাও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। গত ৮ বছরে দলের জেলা পর্যায়ের নেতারা আরো সম্পদশালী হয়েছেন। অনেক স্থানে তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের ব্যবহার করে ব্যবসা বাণিজ্য এবং এলাকার অধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছেন। সময় হলেই তারা এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবেন।
বর্তমানে অফিসিয়াল বিরোধী দল জাতীয় পার্টির জেলা পর্যায়ের নেতারা “মার ছক্কা” রনকৌশল অবলম্বন করে রাজনীতির মাঠে সরব হয়েছেন। তাদের আশা ২০১৪ সালের নির্বাচন হবে “বিকাশ মার্কা”। নির্বাচনে আসন ভাগাভাগী করে তারা হিসাব ছাড়াই সব নিকাশ করে ফেলবেন। ছক্কা বেশী মারতে পারলে তারাই সরকার গঠন করবেন। জাতীয় পার্টির একজন নীতি নির্ধারক মনে করছেন হিসাবের আসল নির্বাচন হলে বিএনপি, আওয়ামী লীগ উভয় দলেরই জাতীয় পার্টিকে প্রয়োজন হবে। তখন তারা শর্ত হিসাবে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাব দেবেন। এবং এরশাদের জীবনের শেষ ইচ্ছাটি পূরণ হবে।
তবে হিসাবের রাজনীতি “বিকাশের রাজনীতিকে” পরাস্ত করবে নাকি “বিকাশ রাজনীতি” আরো বিকাশমান হবে তা সময় বলে দেবে। হিসাব এবং বিকাশের এই দ্বন্দ্বে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিকাশ হয়ে যাবার আশংকাতো রয়েই গেল।

লেখক – সাংবাদিক কলামিস্ট, সম্পাদক দৈনিক বাঁকখালী