নুরুল কবির বান্দরবান থেকে,

মো জহিরুল ইসলাম চাকুরী সূত্রে পেশায় মেকানিক। রোয়াংছড়ি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগে কাজ করেন। চাকুরীর পাশাপাশি ঠিকাদারীও করেন। তবে অন্যজনের ঠিকাদারী লাইসেন্স দিয়ে। চাকুরী সূত্রে তিনি অফিসের বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছেন। এই সুবাদে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আতাত করে কাজ হাতিয়ে নিয়ে ঠিকাদারী কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। চলতি বছর গত জুন মাসে তড়িঘড়ি করে ২৬ লাখ টাকার কাজ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। আর এ কাজে সহযোগিতা করেছেন রোয়াংছড়ি উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ (পাবলিক হেল্থ)। এই কাজের পেছনে মূলহোতা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সোহরার হোসেন জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে। কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য তাকে মোটা অংকের পার্সেন্টিস দিতে হয় এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রয়াত ঠিকাদার উচনু মার্মার নামে ঠিকাদারী লাইসেন্সে কাজটি হাতিয়ে নিয়েছেন মো: জহিরুল ইসলাম।

শনিবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থ সালে জুন ফাইনালের আগে তড়িঘড়ি করে রোয়াংছড়ি উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের উপসহকারি প্রকৌশলীর সাথে আতাত করেই চারটি ইউনিয়নে ২৮টি রিংওয়েল স্থাপনের কাজ নেয়া হয়। বান্দরবানের মৃত ঠিকাদার মিঃ উচনু মারমা এর প্রতিষ্ঠানের নামে কাজটি নিয়েছেন পাবলিক হেলথের মেকানিক মোঃ জহিরুল ইসলাম নিজেই তার সাথে সকল কাজে জড়িত রয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সোহরার হোসেন। জহিরুল ইসলাম। রোয়াংছড়ি উপজেলা পাবলিক হেলথ অফিসে টানা দীর্ঘ ত্রিশ বছরের অধিক চাকুরী করেছেন। অভিযোগে জানা যায়, প্রতিটি রিংওয়েল স্থাপনের জন্য দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে বরাদ্দ দেয়া হয় ৯২হাজার টাকা। ২৮টি রিংওয়েলের বিপরীতে ২৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বরাদ্দ পায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি। উপজেলার চারটি ইউনিয়নে এসব রিংওয়েল স্থাপন কবরা হবে। রিংওয়েল স্থাপনের কথা থাকলেও এখনো অনেক জায়গায় বসানো হয়নি। আর যেসব জায়গায় বসানো তাও ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য বসানো হয়েছে। অথচ কথা ছিল এলাকার মানুষকে পানি সুবিধা নিশ্চিত করা। আর রিংওয়েলগুলো স্থাপন করা হয়েছে চলতি বর্ষা মৌসুমেই। এতে করে কম গভীরতায় রিংওয়েলে পানি পাওয়া যাচ্ছে। কম গভীরতা করার ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি পাওয়া গেলেও গরমের সময় পানি নিয়ে হাহাকার পড়বে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কম গভীরতায় রিংওয়েল স্থাপনের ফলে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন মেকানিক মো: জহিরুল ইসলাম। আর পানি সংকটে পড়তে হচ্ছে এলাকার মানুষের। গভীরতা কম হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময় অকেজো পড়ে থাকবে রিংওয়েলগুলো। রিংওয়েল স্থাপন করা হলেও বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে স্থানীয়দের কোনো কাজে আসবে না রিংওয়েলটি।

রোয়াংছড়ির স্থানীয় বাসিন্দা সাচিংথুই মারমা জানান, ওয়াগই পাড়ায় তার বড় ভাই রেদাক মার্মার ঘরের পাশে গত নভেম্বরে একটি রিংওয়েল স্থপন করা হয়েছে। ১৬ফুট পর্যন্ত খনন করে রিংয়েলটি বসানো হয়েছে। চলতি বছরে জুনে পাবলিক হেল্থ এর মেকানিক মোঃ জহিরুল ইসলাম নিজেই বাকী কাজগুলো সম্পন্ন করে দিয়েছেন। গত বছরের পুরনো কাজে ১৬ফুট বাদ দিয়ে মোট ৩৪ফুট খনন করে রিং বসানোর পর হেন্ডল পাম্প বসিয়ে দিয়েছেন। কাজটি পাগলাছড়া এলাকার যুবলীগের সভাপতিকে নিয়ে জহিরুল ইসলাম নিজেই করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। হানসামা পাড়ার ইউপি সদস্য অংশৈনু মারমা জানান, হানসামা পাড়ায় তীব্র পানি সংকট চলছে। রিংওয়েলটি হানসামা পাড়ায় স্থাপন করা হয়নি। রসহ্যজনক কারনে পাড়া থেকে দূরে উনুমং মার্মার খামারে স্থাপন করা হয়েছে। যেটি সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসবেনা। উনুমং মারমা বলেন, রিংওয়েলটি স্থাপনের জন্য ছয় হাজার টাকা দিতে হয়েছে জহিরুল ইসলামকে।

উনুমং খামারে রিংওয়েল স্থাপনের কাজে নিয়োজিত শ্রমিক মোঃ বেলাল উদ্দিন ও মোঃ কায়সার বলেন, রিংওয়েলটি স্থপনে ঠিকাদারি কাজ করেছেন রোয়াংছড়ি উপজেলার পাবলিক হেল্থ এর মোঃ জহিরুল ইসলাম। কাজ ভালভাবে করার জন্য নিয়মিত দেখতে আসেন ঠিকাদার হিসেবে। উপজেলার বেঙছড়ি উপরে লুলইং পাড়ায় একটি রিংওয়েল স্থাপনের কথা থাকলেও এখনো করা হয়নি। রিংওয়েলের বরাদ্দ ৯২হাজার টাকা থেকে ছোট্ট একটি পানির ট্যাংক নির্মাণ করেই বাকি টাকা আত্মসাত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের এই কর্মচারি। ওই পাড়ার বাসিন্দা পুনথাং বম বলেন, তাদের পাড়ায় কোন রিংওয়েল স্থাপন হয়নি। আট ব্যাগ সিমেন্ট, এক হাজার ইট, প্রয়োজনীয় বালু ও কংকর দিয়ে ছোট্ট একটি পানির ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। কাজটি করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য ক্যনুমং মারমা এর মাধ্যমে। পানির ট্যাংক নির্মাণ কাজে ২৫-৩০হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

তারাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উথোয়াইচিং মারমা বলেন, হানসামা পাড়া বৌদ্ধ বিহারে রিংওয়েল স্থপনের কথা ছিল। পাবলিক হেল্থ এর জহিরের সাথে আর্থিক লেনদেন করেই উনুমং মারমা খামারে স্থাপন করেছে। যেটি সাধারণ মানুষের কোন কাজে আসছেনা। আমি এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসে আপত্তি জানাবো।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের বান্দরবান অফিসের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের রোয়াংছড়ি উপজেলা উপ-সহকারি প্রকৌশলী সৈয়দ গোলাম আশরাফ হলেন চোর। আর মেকানিক মোঃ জহিরুল ইসলাম হলেন ডাকাত। তারা যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছেন। এদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। এবং নির্বাহী প্রকৌশলী সোহরাব হোসেন তাদেরকে সহযোগিতা করছেন। জানা গেছে, প্রতিটি কাজের পেছনে নির্বাহী প্রকৌশলীকে শতকরা ১৫-২০ পার্সেন্ট টাকা দিতে হয়। তা না হলে কাজ করতে পারে না ঠিকাদারেরা।

এবিষয়ে মেকানিক মোঃ জহিরুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি ঠিকাদারি কাজে জড়িত নন। একজন মেকানিক হিসেবে রিংওয়েল স্থাপনের সরকারি কাজে ঠিকাদরকে সহায়তা করছেন। তবে লুলইং পাড়ায় রিংওয়েলের বদলে এক হাজার ইট ও আট ব্যাগ সিমেন্ট দিয়ে পানির টেংকি নির্মাণ কাজে তার ৫০হাজার টাকার মত খরচ হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন।

এই প্রতিষ্ঠানের রোয়াংছড়ি উপজেলার উপসহকারি প্রকৌশলী সৈয়দ গোলাম আশরাফ বলেন, অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে। তবে সব কাজ সঠিকভাবে হয়েছে দাবি করছিনা। আমারও ব্যর্থতা থাকতে পারে। পুরানো রিংওয়েল মেরামত করে নতুন বিল দেয়া হবেনা। সরেজমিনে খতিয়ে দেখবো।