হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ
পাহাড় ধ্বস এবং প্রবল বর্ষনেও টেকনাফে পাহাড় ধ্বসের ঝুঁকিতে অসংখ্য মানুষ পাহাড়ে এবং পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে। গত কয়েক বছর ধরে টেকনাফ উপজেলায় পাহাড় ধ্বসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। বার বার প্রাণহানি এবং প্রশাসনের সতর্কতা সত্বেও পাহাড়ের পাদদেশ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের সরিয়ে আনা যাচ্ছে না। বর্তমানে টেকনাফের ১৩টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে কয়েক হাজার পরিবার মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। চলতি বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় বনবিভাগ পৌরসভা ইউনিয়ন পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে বলা হলেও কেউই শুনছেন না প্রশাসনের সতর্কবাণী।
গত ১ সপ্তাহ ধরে টানা প্রবল বর্ষণে টেকনাফের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। টানা প্রবল বর্ষণে অস্বাভাবিক উচ্চতায় পানির কারণে টেকনাফ-কক্সবাজার প্রধান সড়কে যানবাহন চলাচল বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তবে টেকনাফ-কক্সবাজার এলজিইডি সড়ক ও মেরিন ড্রাইভ সড়ক চালু আছে। উপজেলার শাহপরীরদ্বীপ, সাবরাং, টেকনাফ পৌর এলাকা, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও টেকনাফ সদরের উপকুলীয় এলাকার শত শত পরিবার পানিবন্ধী হয়ে রয়েছে। জোয়ারের পানি বৃদ্ধির ফলে চিংড়ি ঘের থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার চিংড়ি ভেসে গেছে। পাশাপাশি পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় ফাঁটল ধরার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরানোর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
প্রশাসনের সঠিক নজরধারীর অভাবে মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করে স্থানীয় ভূমিদস্যু দখলদাররাই এদের আশ্রয় দিয়ে মাসোহারা নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতি বছর বন বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তারা লোক দেখানো অভিযান ও অবৈধ উচ্ছেদ পরিচালনা করলেও পরবর্তীতে আবারো স্থানীয় ভূমিদস্যুরা বন বিভাগের অসাধু কিছু কর্মকর্তার সাথে আঁতাত করে পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে রোহিঙ্গাদের বসতি করার সুযোগ করে দেয়। তাছাড়া স্থানীয়দের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ের পাদদেশে রীতিমত সমাজ গঠন করে বসতি করে বসবাস করে আসছে বলে জানা গেছে।
উপজেলা প্রশাসন সুত্র জানান, চলতি বর্ষা মৌসুম শুরুতেই ইতোমধ্যে পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা থাকায় স্থানীয় প্রশাসন পাহাড়ের ঢালুতে বসবাসরত এসব পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা পরিবারকে স্থানীয় সাইক্লোন শেল্টার ও শিক্ষা প্রতিষ্টানে স্থান করে দিতে বলা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৫ ও সংশোধিত ২০১০ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন দখলীয় অথবা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন, মোচন করা যাবে না। এ আইনে পাহাড় কাটার অপরাধে সর্বোচ্চ দুই বছরের জেল ও ৫ লাখ টাকার জরিমানা বিধান থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগ পাহাড় কাটার অপরাধে এ পর্যন্ত কাউকে জরিমানা বা শাস্তির আওতায় আনেনি। যে কারণে টেকনাফ উপজেলায় পাহাড় দখল, কর্তন, স্থাপনা তৈরি ও অবৈধ বসবাস অব্যাহত রয়েছে। এর আগে চিহ্নিত ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরত বাসিন্দাদের উচ্ছেদে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উপজেলা প্রশাসন। কিন্ত তা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। বর্ষা এলেই টেকনাফে পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষেরা মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ে। তারপরও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কয়েক হাজার মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে। কয়েকদিনের টানা বর্ষণে টেকনাফে পাহাড় ধস নিয়ে বাড়ছে আতংক। কয়েক হাজার পরিবার পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে।
জানা যায়, টেকনাফ বন বিভাগের হোয়াইক্যং, টেকনাফ ও শীলখালী রেঞ্জের আওতায় টেকনাফ পৌরসভা, সদর, হ্নীলা ও বাহারছড়া ইউনিয়নে ১২ হাজার ৬২.১৬ হেক্টর পাহাড় রয়েছে। পাহাড়ে বসবাসকারী বসতির সঠিক হিসেব সংশ্লিষ্ট বন বিভাগে নেই। তবে গত বছর পাহাড়সমূহে হাজারো ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের তালিকা উপজেলা প্রশাসনে প্রেরণ করা হয় এবং চলতি বছরও তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্ত কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা।
সম্প্রতি প্রকাশিত দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের কম্পিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট পারফরমেন্সের (সিডিএমপি) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে শুধু বর্ষণের কারণে নয়, ভূমিকম্পেও পাহাড় ধসের ব্যাপক জানমাল ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয় টেকনাফে পাহাড়গুলোর মধ্যে ১৩টি পাহাড় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। যেসব পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস সেগুলো হচ্ছে- টেকনাফ পৌরসভার পুরাতন পল্লানপাড়া, ফকিরামুরা, কাদিরঘোনা, নাইট্যংপাড়া, শিয়াইল¬্যাঘোনা, চাইল্লাতলী, বরইতলী উঠনি, সদর ইউনিয়নের বরইতলী, কেরুনতলী, নতুন পল্লানপাড়া, মাঠপাড়া, জাহালিয়াপাড়া, চন্দরকিল্লা, রাজারছড়া, হাবিরছড়া, মিঠাপানিরছড়া, হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া, জাদিমুরা, রঙ্গিখালী, মুরাপাড়া, পশ্চিম সিকদারপাড়া, মইন্যার ঝুম, ঘোনাপাড়া, পশ্চিম পানখালী, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের দৈংগাকাটা, লাতুরীখোলা, হরিখোলা, রইক্ষং, নয়াপাড়া, কম্বনিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া ও পশ্চিম কুতুবদিয়াপাড়া, আমতলী ইত্যাদি। এসব পাহাড়ে বালির পরিমাণ বেশি। বৃষ্টির সময় বালিতে পানি ঢুকে নরম হওয়ার পর ধসে পড়ে। বৃষ্টি ছাড়া ভূমিকম্পেও যে কোনো মুহূর্তে পাহাড়গুলো ধসে পড়তে পারে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের ১৫ জুন কক্সবাজারের টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসে ৫৮ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে টেকনাফেই মারা যায় ৩৪ জন। ২০০৮ সালের ৪ ও ৬ জুলাই টেকনাফের ফকিরা মোরা ও টুইন্যার পাহাড় ধসে একই পরিবারের চারজনসহ ১৩ জন মারা যায়। এবছর ১৪ জুন হোয়াইক্যং ইউনিয়নে পাহাড় ধ্বসে মারা গেছেন পিতা ও শিশু কন্যা। এসময় ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে অর্ধশতাধিক বসত বাড়িসহ শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু আহত হয়েছিল। প্রতি বছর বর্ষায় প্রবল বর্ষণে টেকনাফ উপজেলায় পাহাড় ধসে নিহতের ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত পাহাড় থেকে ঝুঁকিপুর্ন বসবাসকারীদের সরানো হয়নি। এতো মৃত্যুর পরও এখনো হাজারো পরিবার জীবনের ঝুকি নিয়ে বসতি করছে পাহাড়ের পাদদেশে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ করুন ট্রাজেডির ঘটার পরেও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের সচেতন করার জন্য কোন ধরনের কর্মসূচী নেয়া হচ্ছেনা।
এমনিতে টেকনাফ প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। এ সংকটাপন্ন এলাকায় অবাদে টিলা, গাছ কর্তন, বন্য প্রাণী শিকার ও পাহাড় কেটে বিরান ভূমিতে পরিণত করার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে ঘন ঘন দুর্যোগ হচ্ছে। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের অধিকাশংই রোহিঙ্গা। এরা বনাঞ্চলের বৃক্ষ নিধন, পাহাড় ও টিলার মাটি কেটে বসতি স্থাপন করে চলেছে। এতে করে যেমনি ভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকিও। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দাবি করেন, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত বেশিরভাগ লোকজন দরিদ্র শ্রেনীর। অভাব-অনটনের সংসারে জর্জরিত হয়ে আবার অনেকে শাহপরীরদ্বীপ নদীর ভাঙ্গনের শিকার হয়ে ভিটেবাড়ি হারানোর পর মুলতঃ এক প্রকার বাধ্য হয়ে এখানে মৃত্যুর ঝুঁিক জেনেও তাঁরা বসবাস করে আসছে। এসব পরিবারকে উচ্ছেদ না করে পুর্নবাসনের আওতায় এনে বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হবে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) তুষার আহমদ এবং ভাইস চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মাওঃ রফিক উদ্দিন জানান বর্ষার শুরু থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে বলা এবং সতর্ক করা হয়েছে