শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার :

কক্সবাজার জেলার আটটি উপজেলার ৭১টি ইউনিয়নের প্রায় ৯’শ গ্রামে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ৯৯২ টি গ্রামের মধ্যে গত কয়েকদিনের বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বুধবার পর্যন্ত ৯’শ গ্রামের সাড়ে ৯ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে আরো নতুন নতুন এলাকা। দাবী উঠেছে কক্সবাজার জেলাকে দূর্গত এলাকা ঘোষণার। বিপর্যস্ত হচ্ছে গ্রাম, পরিবার ও জেলাবাসির স্বাভাবিক জীবন যাত্রা।

বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সামনে পরীক্ষা অনুষ্ঠান নিয়ে শংকায় রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চকরিয়া থানা সহ সরকারী অনেক ভবনে পানি ঢুকে পড়ায় দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

গত পাঁচ দিনের টানা বৃষ্টিতে জেলার চকরিয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, উখিয়া ও টেকনাফ সহ জেলার অধিকাংশ এলাকায় বন্যা সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছে চকরিয়া উপজেলায় ৩ লাখ, কক্সবাজার সদরে অন্তত ১ লাখ, রামুতে ১ লাখ, উখিয়ায় ১ লাখ, টেকনাফে ১ লাখ, পেকুয়ায় ৫০ হাজার, কুতুবদিয়া ১ লাখ ও মহেশখালী উপজেলায় ১ লাখ সহ আট উপজেলায় সাড়ে ৯ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে জনপদ। তলিয়ে গেছে বীজতলাসহ ফসলী জমি, চিংড়ি ঘের। জেলার প্রধাননদী মাতামুহুরী, বাঁকখালী, রেজু, কোহালিয়া ও নাফনদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে । কক্সবাজারের ৪টি পৌরসভা কক্সবাজার, চকরিয়া, টেকনাফ ও মহেশখালী পৌরবাসিও পানিবন্দি হয়েছে।

এছাড়াও মহেশখালী মাতারবাড়ি, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, শাহ্পরীর দ্বীপ, ছেডাঁ দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসিও অনেকটা গৃহবন্দি হয়ে আছে। সবদিকে পানি আর পানির কারণে অনেকেই ঘরবন্দি, আবার অনেক মানুষ পানিবন্দি হয়ে ঘরবাড়ি ফেলে নিরাপদে সরে এসেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টানা প্রবল বর্ষণের কারণে মাতামুহুরীর নদীর পানি উপচে চকরিয়া উপজেলার পৌসভার ৯নং ওয়ার্ড এবং সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, হারবাং, কোনখালী, ঢেমুশিয়া, খুটাখালী, ডুলাহাজারা, সাহারবিল পুরোসহ ১৭ ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে অন্তত তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

এদিকে, বুধবার সকালে জেলার সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা চকরিয়া সুরাজপুর- মানিকপুর ইউনিয়নের বন্যা দূর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরন করেন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান, সহ-সভাপতি এড. আমজাদ হোসেন,সহ-সভাপতি রেজাউল করিম,এটিএম জিয়া উদ্দিন চৌধুরী জিয়া, আমিনুর রশীদ দুলাল, মিজানুর রহমান, উম্মে কুলসুম মিনু, দৈনিক বাকঁখালী সম্পাদক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক কমিশনার ফজলুল করিম সাঈদী, স্থানীয় চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম, সাবুউদ্দিন।

কক্সবাজার সদরের ১০টি ইউনিয়ন পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। বন্যার উপক্রম হয়ে পানিবন্দি মানবেতর জীবনযাপন করছে সদর ও পৌরসভার অন্তত ১ লাখ মানুষ। ঈদগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিম ভোমরিয়াঘোনা, দরগাহ পাড়াসহ ৮টি গ্রাম, ইসলামাবাদের খোদাইবাড়ী, ওয়াহেদরপাড়া, হিন্দু পাড়ারসহ ৬ টি গ্রাম, জালালাবাদের লরাবাক এলাকায় বেড়িবাধ ভাঙনে মোহনবিলাসহ ৯টি গ্রাম, পোকখালী, ইসলামপুর এবং চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের ২১টি গ্রাম জোয়ারের পানি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়াও পিএমখালী, ঝিংলংজা ইউনিয়নের ২৪টি গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে আছে।

চকরিয়া

৫ জুলাই সকাল ১০ টার দিকে জালালাবাদের রাবার ডেম সংলগ্ন বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিএম রহিম উল্লাহ, ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছৈয়দ আলম, ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর খায়রুজ্জামান।

রামু উপজেলায় টানা বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে রামুতে বাঁকখালী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদ সীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি, ঈদগড়-ঈদগাঁও সড়কসহ বেশ কয়েকটি সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মঙ্গলবার সকাল থেকে গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, ঈদগড় ও রাজারকুল ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী ৬০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে।

অতিবর্ষণে মহেশখালীতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বীজতলাসহ ফসলী জমি ও চিংড়ি ঘের পাহাড়ি ঢলে এবং জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে কাঁচা বাড়ীঘর ও ফসলি জমি। টানা ৫ দিনের ভারী বর্ষণে মহেশখালী উপজেলার পৌরসভাসহ ৮ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। হোয়ানক ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম এর বাড়ীতে পাহাড়ী ঢলের পানি ডুকে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। মাতারবাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি জি এম ছমি উদ্দীন জানান, মাতারবাড়ী ইউনিয়নের মগড়েইল, ফুলজান মোরা, রাজঘাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকা বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়। পৌরসভার ঘোনারপাড়া এলাকার বশিরের বাড়ীসহ বেশ কয়েকটি বাড়ী পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

ধলঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান জানান, প্রবল বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে ধলঘাটার কয়েকটি গ্রামের সড়কের উপর পানি ওঠে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

উখিয়া পালং খালী

বর্ষার মৌসুমের ধানের বীজতলা, পানের বরজ এর ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। বিল এর পান বরজ বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গিয়ে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

পেকুয়ায় মাতামুহুরী নদী দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে এসে প্লাবিত হয়েছে লোকালয়। পেকুয়া সদর ইউনিয়নের পূর্ব মেহেরনামা, মোরার পাড়া ও শীলখালী ইউনিয়নের হাজীর ঘোনা, মাঝের ঘোনা, জারুলবনিয়াসহ ২৫ গ্রামের মানুষ এখন পানিবন্দি রয়েছে।

এদিকে বরইতলি-মগনামা সড়কের ১কিলোমিটার অংশ (সালাউদ্দিন ব্রীজ এলাকা থেকে পঁহরচাদা মাদ্রাসা পর্যন্ত) পানিতে ডুবে থাকায় বন্ধ রয়েছে চকরিয়া-পেকুয়ার যান চলাচল। তবে যাত্রীরা সড়কের এ অংশটি পারাপার হচ্ছেন নৌকা ও ভ্যান যোগে। এভাবেই পেকুয়া থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের সাথে যোগাযোগ করছেন ৫০ হাজার মানুষ।

উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায়ও ২৬টি ইউনিয়ন পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। বন্যার উপক্রম হয়ে পানিবন্দি মানবেতর জীবনযাপন করছে দুই উপজেলার ও ১টি পৌরসভার অন্তত ২ লাখ মানুষ।

কুতুবদিয়া দ্বীপের চারদিকে টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে সাগরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে চিংড়ি ঘের, বসতবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ ছাড়া কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল, তাবলের চর, উত্তর ধুরং, লেমশীখালী, চর ধুরং, কৈয়ারবিল, বড়ঘোপসহ আরও কয়েকটি এলাকায় বন্যায় অসংখ্য পুকুর, চিংড়ি ঘের ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। গত ৪-৫ দিন ধরে চিংড়ি ঘের প্লাবিত হয়ে ঘেরের প্রায় ৭৫ ভাগ মাছ পানিতে ভেসে গেছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন বলেন, ‘চকরিয়ায় বন্যা পরিস্থিতি অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করেছে। রামুতেও পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। সব স্থানের বন্যা কবলিত মানুষকে সহযোগিতা করা হবে। এরই মধ্যে চকরিয়ার জন্য এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অন্যান্য এলাকার জন্যও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বুধবার জেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে।’