এম, শহিদ উদ্দীন সোহেল
‘চকরিয়ার মানুষ আরা
আরার হন দুঃখ নাই,
মতামরির খাচাত আরা
সুখর গীত গেই’
রাহগীর মাহমুদ স্যারের নির্দেশনায় শিশুশিল্পীদের পরিবেশনায় প্রায় আড়াই দশক পূর্বে এই আঞ্চলিক গান শুনে পুলকসঞ্চারিত হৃদয়ে অনেক গর্ববোধ করতাম চকরিয়া আর মাতামুহুরীকে নিয়ে। ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি এই নদীকে ঘিরে। এর ছোট শাখানদীতে ছোট আল দিয়ে পানি সেচ, মাছ ধরা, বটগাছের মগডাল থেকে পানিতে লাফিয়ে পরা, স্কুল পালিয়ে বাধা নৌকা খুলে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে দাড় টানা, মাটির তৈজস নিয়ে সম্পানের নোঙ্গর, বাঁশ আর গাছের ভাসমান ভেলা। রত্রিবেলায় দাদার বুকে মাথাগুজিয়ে বিশাল আকৃতির মাছ জাল ছিড়ে পালিয়ে নৌকাসহ সাগরের দিকে নিয়ে যাওয়া অথবা রাজকুমারীর লামা মাতামুহুরী নদীর পাশে সুখ্যা-দুঃখ্যা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান নেয়ার গল্প শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে যাওয়া।
অতীতে লামা, আলিকদম, নাইক্ষংছড়ি সহ বৃহত্তর বন্দরবান জেলার অধিকাংশ অধিবাসীর যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম এই প্রবাহমান নদী। চকরিয়া গড়াতে যার অবদান, এই জনপদে জনবসতি ও চিরিঙ্গার মত উপশহরের গোড়াপত্তন তাকে ঘিরে। সময়ে সময়ে এই নদীর পথচলায় মানচিত্রে দিয়েছে বৈচিত্রতা, সে কিনা চকরিয়ার দুঃখ হয়ে দাড়িয়েছে ? সৃষ্টিতে যার আনন্দ সে বিনাশী হয় কিভাবে? তারপরেও তার সর্বগ্রাসী ভয়ালরূপ সত্যি চকরিয়াবাসীকে ভাবিয়ে তুলছে। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিপট থেকে তার এই রাক্ষুসে রূপকে চিহ্নিত ও পোষমানার পথে গমণ করার চেষ্টা করছি।
চট্টগ্রাম আর আরাকানকে বিভক্তকারী পর্বতমালায় ২১°১৪´ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯২°৩৬´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ উদ্ভূত মাতামুহুরী নদী। এর
উৎসস্থান সাঙ্গু নদীর উৎস থেকে মাত্র ১° উত্তর ও ১° পূর্বে অবস্থিত। মগ ভাষায় নদীটির নাম মামুরি, মামুরি শব্দের অর্থ মায়ের মত। ভয়ে (হাতিকে যে রকম নাম উচ্চারণ না করে মামু ডাকত) বা মমতায় স্রোতস্বিনী এই নদীকে মায়ের সদৃশতা খুজ্ ত দু’পারের মানুষ। কালের বিবর্তনে বাংলা বই পুস্তকে এর নাম হয় মাতামুহুরী।
মাতামুহুরী মায়েনমারের মাইভার পর্বত হতে মতান্তরে বাংলাদেশে উৎপত্তি হয়ে সাঙ্গুর মতো চট্টগ্রামের উত্তর-পশ্চিম দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পূর্ব দিক দিয়ে কক্সবাজার জেলায় প্রবেশ করেছে এবং ২১°৪৫´ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯১°৫৭´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ ২৮৭ কি: মি:।
আশির দশকে এ নদীর গভীরতা ছিল ৫০ থেকে ৬০ ফুট, প্রশস্ত ৫০০ থেকে ৭০০ মিটার, আয়তন প্রায় ১৮০০ একর। তবে নদীর সংযোকারী বিভিন্ন ছোট-বড় ঝিড়িতে পাহাড়ের পাদদেশ খোদাই করে নির্বিচারে পাথর আহরনের কারনে পানির উৎসগুলো শুকিয়ে গেছে। পাহাড়ের বালি আর পলিমাটি জমে নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে গভীরতা ১৫ থেকে ২০ মিটারে চলে এসছে। বর্ষা থামতেই না থামতেই মাতামুহুরী নদীর উজানে চম্পাতলী, লামারমুখ, আলীকদম বাজার, পোয়া মুহুরী এলাকায় একাধিক ছোট বড় চর জেগে উঠে । নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, পাহাড় খুদে পাথর উত্তোলন, জুম চাষের নামে পাহাড়ে আগুন দিয়ে সবুজ বৃক্ষ ধ্বংস, অপরিকল্পিত জুম চাষ, ঝিরি, ছড়া ভরাট, নদীর দু’পাড়ে অপরিকল্পিত তামাক চাষ ও তামাক প্রক্রিয়াজাত করণের জ্বলানীর জন্য সবুজবনানী নিধন, নদীর দুপাড় অবৈধ দখল মাতামুহুরীর নাব্যতা হারানোর জন্য দায়ী করেছেন এলাকাবাসী ও পরিবেশ সচেতন মহল। ভাটির অঞ্চলে রাবার ড্যাম যত গভীরে থাকার কথা টিকততটুকু না হওয়া, যত্র তত্র নদীর গতি প্রবাহে বাধ নির্মাণ করে অনুমোদিত বা অঅনুমোদিত ভাবে চিংড়ি চাষকেও অভিজ্ঞমহল এই সমস্যা সৃষ্টিতে ক্রীড়ানক মনে করেন।
এই সমস্যাকে সাময়িক সমাধান না করে স্থায়ী ও দীর্ঘ মেয়াদি সমাধান করায় বুদ্ধিমানের কাজ হবে। অন্যতায় শুধু দু:খই প্রলম্বিত হবে।
কিছু দাবী সদয় বিবেচনার জন্য লিপিবদ্ধ করলাম:
১. ড্রেজিং করে নব্যতা ফিরিয়ে আনা। (যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতি জোর দাবী উঠলেও লোকে মুখে শুনা যাচ্ছেযে কোন নদী ড্রেজিং করার আগে জরিপ করতে হয়। তবে এ নদীটি এখনও জড়িপের আওতায় আসেনি। যদি তাই হয় তবে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কাম্য।)
২. নতুন কার্লবার্ট বা সেতু নির্মাণ ও পুরাতন গুলো সংস্কার।
৩. দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য নদীর ভাটির দিকে গভীর জলধার খনন।
৪. অপরিকল্পিত স্থাপনা ও দখল উচ্ছেদ।
৫. শহর রক্ষা বাধ ও নর্দমা নির্মাণ।
৬. পাহাড়ের পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার যে কোন মূল্যে প্রচেষ্টা জোড়ালো করা।
৭. তামাক চাষ বন্ধকরা।
সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা , জনসচেতনতা ও সম্পৃক্তা বাড়িয়ে এই দাবী গুলোকে বেগবান করি। মাতামুহুরি নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে প্রাণের চকরিয়াকে জলাবদ্ধতা ও বন্যার হাত থেকে রক্ষা করি।
লিখকঃ ব্যাংক কর্মকর্তা।