রফিকুল ইসলাম :
উখিয়ার রোহিঙ্গা বস্তিকে গুলোকে ঘিরে সন্ত্রাসীদের রাম রাজত্ব ও অপতৎপরতা বাড়ছে। বস্তিগুলোতে বিরাজমান সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে এক মাসের ব্যবধানে অপহৃত কুতুপালং নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের ৩ জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এসব ঘটনার রেশ না কাটতেই বৃস্পতিবার দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিককে উক্ত সন্ত্রাসীরা হত্যার লক্ষে উপযুপরি ছুরিকাঘাত করে গুরুতর জখম করে। অপহরণ ও খুনের ভয়ে কুতুপালং শিবিরের রোহিঙ্গা মাঝিরা (নেতা) আতংকিত হয়ে অজ্ঞাত স্থানে রাত কাটাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। একের পর এক অপহরণ ও খুনের ঘটনায় জড়িত কাউকে পুলিশ বা গোয়েন্দারা আইনের আওতায় আনতে পারছে না।
বৃস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তির খেলার মাঠ সংলগ্ন চা দোকানে সন্ত্রসাীরা অস্ত্রেশস্ত্রে সেখানে ডুকে আবু ছিদ্দিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। স্থানীয় রোহিঙ্গারা এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। গুরুতর অবস্থায় রোহিঙ্গা নেতা আবু ছিদ্দিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধিন রয়েছে বলে জানা গেছে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের চাঁদ রাত ২৫ জুন রাত ৮টার দিকে উখিয়া থানা পুলিশ বালুখালী তেলীপাড়া খাল পাড়ের ঝোঁপ থেকে হাত, পা বাঁধা, গলা কাটা একজনের লাশ উদ্ধার করেছে। উখিয়া থানার ওসি মোঃ আবুল খায়ের বলেছেন, লাশ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় সনাক্ত করা যায়নি। কুতুপালং নিবন্ধিত শিবিরের ই-১ ব্লকের অপহৃত রোহিঙ্গা মাঝি মোঃ আয়ুব (৩০) এর স্ত্রী ২ সন্তানের জননী নুর আলকিছ প্রাথমিকভাবে তার স্বামীর লাশ বলে সনাক্ত করায় ময়না তদন্ত শেষে তার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে উক্ত লাশের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য গত ১৩ জুন রাত দেড়টার দিকে ১৮/২০ জনের একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপে হানা দিয়ে কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের ই-১ ব্লক নেতা মোঃ আয়ুব মাঝি ও কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্পের শরণার্থী আলী আহমদের ছেলে মোঃ সেলিম (২৬) কে তাদের ঘর লুটপাট করে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তৎমধ্যে গত ১৮ জুন দুপুরে বালুখালী তেলীপাড়া খাল থেকে ভাসমান হাত পা বাঁধা ও গলা কাটা অবস্থায় মোঃ সেলিম এর এবং গত রোববার রাত ৮টার দিকে অপহৃত রোহিঙ্গা মোঃ আয়ুব মাঝি একই অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে উখিয়া থানা পুলিশ। একই ভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গত ২৩ মে কুতুপালং নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের মালয়েশিয়া ফেরত মৃত ইমাম হোসেনের ছেলে মোঃ শফি (২৬) কে রাতের অন্ধকারে শিবির থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অপহরণের ৩ দিনের মাথায় ২৫ মে সকালে পার্শ্ববর্তী মধুরছড়া জঙ্গল থেকে রোহিঙ্গা মোঃ শফির লাশ উদ্ধার করে উখিয়া থানা পুলিশ।
সিরিজ অপহরণ ও খুনের ঘটনায় পুলিশ এ পর্যন্ত জড়িত কাউকে আইনের আওতায় আনতে পারেনি। কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক, সাধারণ সম্পাদক মোঃ নুর সহ রোহিঙ্গা জানান, অপহরণকারী ও খুনীদের মধ্যে কুতুপালং শিবির ও বালুখালী বস্তির রোহিঙ্গা কলিম উল্লাহ, ছলিম উল্লাহ, ইসমাইল কুতুপালং বস্তির সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা মোঃ জাবের (৩২), মোঃ নুর (২৮), মনির আহামদ (২৮), খুইল্যা মিয়া মুন্না (৩২), সলিম (২৬), কলিমুল্লাহ (২৮) ও বালুখালীর নতুন রোহিঙ্গা বস্তির মোঃ কালু (৩৫) ও মো ইসলাম (৩৩) এর নেতৃত্বে ১৮/২০ জনের স্বশস্ত্র একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ আয়ুব মাঝির ঘরে হানা দিয়ে তাকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে যায়। এরা সকলেই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল ইয়াকিনের পক্ষ হয়ে এখানে কাজ করছে। তারা সকলে চিহ্নিত হলেও আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকায় সহজে আটক হচ্ছে না। অপহরণ ও খুনের শিকার আয়ুব মাঝির স্ত্রী নুর আনকিছ জানান, ১৮/২০ জন সন্ত্রাসীর মধ্যে উল্লেখিতদের চিহ্নিত করা গেছে। কুতুপালং নিবন্ধিত শিবিরে খুন হওয়া মোঃ শফির ভাই মোঃ হাছানও একই কথা বলেন।
কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান রোহিঙ্গা নেতা মোঃ আবু ছিদ্দিক জানান, একের পর এক অপহরণ ও খুনের ঘটনা ঘটায় আমরা যারা সরকারের আইন কানুন মেনে এখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করি, তাদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। কারণ, অপহরণকারী ও খুনীরা মিয়ানমারের কথাকথিত জিহাদরত আলেকিনের পক্ষ হয়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে কাজ করে যাচ্ছে। তারা মূলত এসব কর্মকান্ডে জড়িত রয়েছে। এরাই কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে দায়িত্বরত নেতাদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দাবী করে ব্যর্থ হয়ে নানাভাবে অপহরণ পূর্বক খুন করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা মাঝিদের অনেকে নিরাপত্তা ও জানের ভয়ে রাতের বেলায় অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে রাত কাটাচ্ছে। তিনি সহ অনেক রোহিঙ্গা দাবী করে জানান, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ না পাওয়া গেলে রোহিঙ্গারা বার্মা ও বাংলাদেশে সমানভাবে নির্যাতন, অপহরণ ও খুনের শিকার হলে তাদের আর কোন উপায় থাকবে না বলে তিনি জানান।
রাজাপালং ইউ,পি, চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, রাজাপালং ইউনিয়নের আওতাধীন কুতুপালং এলাকায় রোহিঙ্গা শিবিরে কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। ওখানে দেশী, বিদেশী অনেক অখ্যাত, বিতর্কিত লোক, সংস্থা, এনজিও মানবতার নামে অবাধ বিচরণ করে অজ্ঞাত অর্থ রোহিঙ্গাদের মাঝে বিলাচ্ছে। ফলে সেখানে নানা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী/গ্রুপের তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে এসব নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও প্রশাসনকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য বলা হলেও, তা কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের ভয়ংকর কর্মকান্ড স্থানীয় লোকজন সর্বদা আতংকে থাকে।