উ হলা থিন রাখাইন :

বাংলাকে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সকল আন্দোলনের আদিবাসীদের অংশ গ্রহণ সম্পর্কে নতুন করে অবতারনার কিছু নেই। বাঙ্গালী-অবাঙ্গালীর বহু তাজা প্রাণের বিসজর্নে ১৯৭১ সালে এই স্বাধীন ভূ- খন্ডের জন্ম। অর্থাৎ বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে স্বাধীনতার অর্জন। স্বাধীনতাত্তোর কালে ক্রমে এদেশের বহু সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে, হচ্ছে এবং আরো হবে। কিন্তু দুভার্গ্যবশঃত এদেশে জনগন, প্রশাসন কিংবা আমাদের সরকার দেশে অসাম্প্রদায়িক মুল্যবোধ রক্ষা করতে পারছে না। দিন দিন আরো অধ:পতনের দিকে ধাবিত হতে দেখা যাচ্ছে। সরকারি দলই হোক বা বিরোধী দল; যারা ক্ষমতায় ছিল, বর্তমানে ক্ষমতায় আছে এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসবে। তাদের হাতে বাংলাদেশের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায় বা অন্য কোন সংখ্যালঘুরা কোন কালে নিরাপদে সুরক্ষিত ছিল না। ভবিষ্যতেও আর নিরাপদে থাকবে বলে আশা করা খুবই কষ্টকর। ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সালে রামুর ট্র্যাজেডি। এই দিন রামুতে সীমা বিহারসহ শত শত বৎসরের পুরনো ঐতিহ্যের ধারক বাহক বারটি বৌদ্ধ

বিহার, প্যাগোডা এবং কয়েকশত বুদ্ধমুর্তি লেলিহান আগুনে ভস্মীভূত হল। হাজার বৎসরের প্রাচীন পুথিঁ-পুস্তক, পান্ডুলিপি, বৌদ্ধদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, বিভিন্ন ভাষায় মুদ্রিত পবিত্র ত্রিপিটক নিমেষেই পুড়ে ছারখার হল। এর পরপরই উখিয়া এবং পটিয়াতেও বৌদ্ধ বিহারসহ বৌদ্ধদের পল্লীতে বাড়িঘর এবং বিভিন্ন ধরনের বৌদ্ধদের ঐতিহ্যবাহী স্থান গুলোকে জ্বালিয়ে শেষ করা হল। একই কায়দায়, লংগদুতেও আদিবাসীদের বাড়িঘর এবং রুজি-রোজগারে দোকান পাটে লুটপাটসহ প্রায় তিনশত ভিটাবাড়ি-দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হল। সেই সাম্প্রদায়িক বিভীষিকার আগুনে ৭ জনের প্রাণহানী ঘটল। সেখানে ৭০ বছরের বয়স্ক জুনাবালা চাকমাকেও জ্যান্ত আগুনে পুড়ে মরতে হল।

রামুতে দুঃখজনক ঘটনা সৃষ্টির আগ মুহূর্তে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের নেতারূপী জানোয়ারগুলো সমাবেশ ঘটিয়ে উস্কানিমূলক সাম্প্রদায়িক আগুন লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যার প্রমাণ বিভিন্ন মিডিয়ায় ধারণকৃত ভিডিও ও স্থির চিত্রে দেখা মেলে। ঠিক তদ্রুপ, লংগদু ট্র্যাজেডিতেও সেনা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উস্কানি দিয়ে, তারা আবার নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অসভ্য নষ্ট সমাজ যাকে বুঝায়। প্রাণের মূল্য এদের কাছে তুচ্ছ ঘটনা। মানুষের মৃত্যু এবং সহায় সম্পত্তি নি:শেষ করে এরা আনন্দ পায়।

আমাদের বিচারহীনতা সংস্কৃতিই, একই ধরনের অপরাধ পুনরাবৃত্তি ঘটাতে এদের সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন প্রত্যেক বারেই নীরব ভূমিকা পালন, সুষ্ঠ তদন্ত না হওয়া এবং বিচারিক বা আইনের আওতায় আনতে না পারায় বার বার অভিযুক্ত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। যারা ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতাকে ইস্যু করে, বিভিন্নভাবে অরাজকতার সৃষ্টি করে অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছে। এ ধরনের অপরাধের অভিযুক্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো যথাযথ আমলে নিয়ে আজীবনের নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতার, বিচারিক বা আইনের আওতা আনা, সুষ্ঠ তদন্ত এবং রাষ্ট্রের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা প্রশাসনের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এসব ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করার পাশাপাশি আড়ালে ইন্দন দাতাসহ জড়িত সকলকে সনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা আশু প্রয়োজন।

রামুর ট্র্যাজেডিসহ দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, হাটহাজারী, নাসিরনগর বা অন্য সকল ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক ইস্যুর ন্যায় লংগদু ট্র্যাজেডিও কালের পরিবর্তনে বিচারহীন ভাবে সরকারের “প্রাথমিক তথ্য বিবরণী”তে ফৌজদারি মামলা দায়ের কেবলমাত্র থানা রেকর্ডকৃত বইতে শেষ যেন না হয়। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতার প্রমাণ আমরা দেখতে চাই।

কারণ, এদেশে সুপ্রীম কোর্টের মত সর্বোচ্চ আদালতে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত “গ্রিস দেবী থেমিস” ভাস্কর্যটি নির্দিষ্ট স্থানে ঠাঁই হচ্ছে না, সেখানে আমাদের মত আদিবাসীদের ন্যায় বিচার, আইনের সমতা ও আশ্রয় লাভের অধিকার পাওয়া যেন এখন  অলীক স্বপ্নের মত।

অথচ সংবিধান বলে, আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। কিন্তু, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ করে ধর্মীয় কিংবা সাম্প্রদায়িকতা ইস্যু গুলোতে আইনের প্রয়োগে মানদন্ড যথাযথ সমানভাবে প্রয়োগ হতে দেখি না। ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িকতা ইস্যুতে অতীতের মত প্রশাসন নীরব ভূমিকা, চিরাচরিত নিয়মে লোক দেখানোর আয়োজনের উপলক্ষ হতে থাকলে বাংলাদেশের আদিবাসীদের বুকের কান্না বুকে চাপা পরে যাবে। যে সরকারের হাতে ক্ষমতা পড়ুক না কেন, আদিবাসীদের পরিস্থিতির আদৌ কোন পরিবর্তন বয়ে আনবে না।

উ হলা থিন রাখাইন, শিক্ষানবীশ আইনজীবী,
ঢাকা জজ কোর্ট।