নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতার শেষ লাইন। রাজা এখানে অদৃশ্য রাষ্ট্রশক্তি। ছোট্ট শিশুর মুখ দিয়ে সেই রাজার বিরু‌দ্ধে কবির কটাক্ষ কবিতার পরতে পরতে। তার কলমে, ‘সবাই দেখছে যে রাজা উলঙ্গ, তবু কারো মনে সংস্কার, কারো ভয়’। কিন্তু এমনই এক উলঙ্গ রাজার সন্ধান মিলেছে যাকে ছুঁয়ে দেখা যায়৷

নাম সুবল বর্মণ৷ বয়স চল্লিশ। ভারতের সাকিন, কোচবিহারের চান্দামারি পঞ্চায়েতের রাজাপুর এলাকায় ‘উলঙ্গ সুবল’ নামে বেশি পরিচিত। অনেকেই বলেন, ‘উলঙ্গ রাজা’। জন্মের পর থেকে শরীরে এক টুকরো সুতো ওঠেনি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা উলঙ্গ থাকেন সুবল। গ্রামেরবাসীদের কাছে এসবই স্বাভাবিক৷ উলঙ্গ অবস্থায় কাজে যান এই রাজা। বাজার করেন। কখনো বাইকে ছুটে বেড়ান। কখনো সাইকেল চালান। চা দোকানে আড্ডা দেন আর পাঁচজনের মতোই। কেউ তাকে নিয়ে কৌতুক করে না৷

এক সময় স্থানীয় ভাইয়েরা জামা-প্যান্টে অভ্যস্ত করতে কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু সুবলের জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে সবাইকে। সুবল নিজেই জানালেন, ছোটবেলা থেকেই শরীরে সুতোর কিছু সহ্য হয় না। চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জামা-প্যান্ট পরলেই কাঁপিয়ে জ্বর আসে।

তাই হাল ছেড়ে ঠিক করেছেন উলঙ্গ থাকবেন। এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। শুধু কি জামা-প্যাণ্ট। বিছানাতেও নেই চাদর। তক্তার উপরে পলিথিন পেতে বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। মাঘের শীতে যখন মানুষ কাবু হয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করে। জ্যাকেট, সোয়েটার, চাদরেও কাজ হয় না তখনো সুবল দিব্যি উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ান। চাদর, কম্বল কিছুই দরকার হয় না তার।

কষ্ট হয় না? প্রশ্ন শুনে হাসেন সুবল। বলেন, সবই অভ্যাস বুঝলেন। আমার কোনো সমস্যা হয় না। অনেকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। লজ্জা পাই না। এভাবেই তো জন্মেছি। কিন্তু দুঃখও কম নেই। উলঙ্গ থাকার জন্য স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। বড় হয়ে বয়স্ক শিক্ষার ‘নাইট স্কুল’-এ কয়েকদিন গিয়েছিলেন। সেখানেই যতটুকু শিখেছেন। ইংরেজি, বাংলা লিখতে ও পড়তে পারেন। নিজে লেখাপড়া করতে পারেননি এই জিদ মেটাতে প্রতিবেশীর এক ছেলের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। সন্তানসম গোকুল বর্মণ এবার মাধ্যমিক পাস করেছে। অনেক দূর পড়াতে চান গোকুলকে৷ সুবল বলেন, ‘আমার হয়নি৷ এই ছেলেটার সব স্বপ্ন পূরণ করব।’

জমি থাকলেও আগে কলমিস্ত্রির কাজ করতেন তিনি। উলঙ্গ অবস্থায় কত বাড়িতে কলের কাজ করেছেন। কেউ তাকে ঘিরে হইচই করেনি৷ এমনকী নারীরাও নয়। এখন কল মিস্ত্রির কাজ ছেড়ে একটি দোকান নিয়ে রান্নার গ্যাস ও ওভেন ভাড়ার দোকান খুলেছেন। দিনের বেশি সময় দোকানেই থাকেন। কখনো খেতে সবজি চাষের কাজ করেন। এবার আট বিঘা জমির মধ্যে ছয় বিঘেতে পাট, পটল ও কচু চাষ করেছেন।

মাত্র দেড় বছর বয়সে বাবা লক্ষ্মীকান্ত বর্মনকে হারিয়েছেন সুবল। মা রাজোবালাদেবী প্রয়াত হয়েছেন ষোলো বছর বয়সে। এরপর থেকে একা। বাড়িতে দুই বেলা নিজেই রান্না করেন। যেদিন শরীর ভালো থাকে না পড়শীদের বাজার করে দেন। ওরাই খাবারের ব্যবস্থা করে৷ বিয়ে করেননি কেন? প্রশ্ন শুনে হোহো করে হাসিতে ফেটে পড়েন বছর চল্লিশের যুবক বলেন, ন্যাংটো রাজাকে কে মেয়ে দেবে বলুন তো। তাছাড়া বিয়ের পরে অনেক দায়িত্ব থাকে৷ ওসব আমার পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়।