মহসীন শেখ

সৌদি আবরের জেদ্দা’য় দেখেছি মানব সৃষ্টির প্রথম মানব আদি মাতা হযরত হাওয়া(আ.) এর পবিত্র কবর। গত ৩মে আমার ঘনিষ্ঠজন সৌদি আরবে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কক্সবাজারের রামু উপজেলার বিশিষ্ঠ শিল্পপতি মো: ইদ্রিস তার পরিবার সহ আমার পরিবারকে নিয়ে যায় জেদ্দায়। সেখানে দেখা হলো জেদ্দার কুর্নিশ অবস্থিত চোখ ধাঁধানো বিভিন্ন শপিং মল, আরব সাগর ও সেখানকার বিভিন্ন অলি গলি সহ ইসলাম ধর্মের বহু ইতিহাসের স্বাক্ষী হিসেবে প্রতীয়মান স্থান গুলো ঘুরে হয়। দেখা হয় আরবের সৌন্দর্য্য ঘেরা জেদ্দা শহরটি। সে সুবাধে দেখার সুযোগ হয়েছে মানবগোষ্ঠীর আদি মাতা মা হাওয়া’র কবরটি। “আল বালাদ নেইভারউড” এর প্রচীনতম কবরস্থানেই আদি মাতা বিবি হাওয়ার কবর। অত্যান্ত শ্রদ্ধার সাথে আমরা মানবজাতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হযরত হাওয়া(আ.) এর কবরটি জিয়াতর করেছি। সীমানার ভেতরে রয়েছে বিশাল আকৃতির বেশ কয়েকটি কবর। তবে সেখানে ঠিক কোন স্থানে মা হাওয়া’র কবর তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি আদৌ। কবরের প্রধান ফটকটি কালো পাথর দিয়ে তৈরী। অত্যান্ত সুন্দর এবং গোছানো এই কবরটি। আদি মাতা হাওয়া’র কবরটি নিজের চোখে দেখে মনে হয়েছে এই জীবনে আরো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র স্থান দেখে মনের আশা পূরণ হল। আলহামদুলিল্লাহ্।

জেদ্দা বা জেদ্দাহ হল সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত তিহামাহ অঞ্চলেরএকটি গুরুত্বপূর্ন শহর। সড়ক পথে মক্কা থেকে জেদ্দা’র দূরত্ব ৪২০কি.মি.। এটি মক্কা প্রদেশের সর্ববৃহৎ ও সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। লোহিত সাগরের উপর অবস্থিত সর্ববৃহৎ সমুদ্রবন্দর এই শহরেই অবস্থিত। ৪৩ লক্ষ জনসংখ্যা নিয়ে শহরটি সৌদি আরবের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র।

সূত্রমতে, জেদ্দা আরবী শব্দ এর বঙ্গানুবাদ হল “দাদি মা”। যেহেতু বিবি হাওয়ার কবর এই শহরে, তাই তার নামেই শহরটির নামকরণ করা জেদ্দা। অনেকেই বলেন যে আদিতে শহরটিকে ডাকা হতো “জুদ্দা” বলে। আর “জুদ্দা” আরবী শব্দের বাংলায় ভাষান্তর করলে অর্থ দাঁড়ায় সাগরতীর। তবে যে যাই বলুন না কেনো আরবীয়দের সাম্রাজ্য পরিচালনার ইতিহাস রয়েছে ১২শ বছরের পুরনো। দুনিয়ার মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে আদম ও ইভ বা হাওয়ার বিষয়ে কোন দ্বিমত আছে বলে আমার জানা নেই।

প্রতœতাত্ত্বিক সাক্ষীপ্রমান কোন কিছু না থাকলেও অজানা আবহমান অতীতের কাল থেকেই এই কিংবদন্তী প্রচলিত যে শহর জেদ্দারই “আল বালাদ নেইভারউড” এর প্রাচীনতম কবরস্থানে রয়েছে সকল মানুষের আদি মাতা “ইভ” বা “বিবি হাওয়া’র কবর। এটি জেদ্দাবাসী মানুষের জন্য এক দু®প্রাপ্য দূর্লভ গর্বের বিষয়। অতএব এ কিংবদন্তী কোন দিনই মানুষের মন থেকে বিলুপ্ত হবে না। আর এটাই স্বাভাবিক।

বিবি হাওয়া, ইংরেজীতে ইভ ডাকা হয়। যাকে দুনিয়ার সারা মানবগোষ্ঠীর আদি মাতা বলা হয়েছে আব্রাহামিক ধর্মে। দুনিয়াতে মানব সৃষ্টির প্রশ্নে এ ধর্মমতে “গড” (স্রষ্টা) আদম ও হাওয়া’কে সৃষ্টি করেন দুনিয়ার স্বর্গে বসবাস করার জন্য। এ দু’জন হলেন মানব জাতির আদি পুরুষ। কিন্তু তারা তাদের এ অবস্থানে থাকতে পারেননি বেরিয়ে আসেন এবং আজকের দুনিয়ার সৃষ্টি করেন। এ চিন্তা, মানুষ ও তার উৎপত্তির মৌলিক দিকের প্রতি নির্দেশ করে বলে যে আসল ওই এক জোড়া মানুষের পরিবার থেকেই দুনিয়ার তাবৎ মানুষের জন্ম। এই আদম ও হাওয়াই দুনিয়ার মানব জাতির একমাত্র আদি মানুষ।

ইহুদিদের রাব্বি সাহিত্যে উল্লেখ আছে দু’টি মতের। এক মতে- নবী আব্রাহাম বিবি সারা সহ তার বুনিয়াদের কবরের জন্য “মেকপেলাহ” নামে একটি মাঠ ও মাঠের শেষে একটি গুহা সহ ভূমি ক্রয় করেছিলেন। আরেকটি মতে নবী আব্রাহাম একদা একটি ছাগল জবাই করার জন্য ধরতে গেলে ছাগলটি মেকপেলাহ মাঠ সংলগ্ন ওই গুহায় প্রবেশ করে। পেছনে পেছনে আব্রাহামও সেই গুহায় প্রবেশ করেন এবং দেখতে পান “আদম ও হাওয়া”র লাশ। যেনো তারা ঘুমিয়ে আছেন। সেই থেকে তিনি ঠিক করেন যে এই ভূমি ও গুহা তিনি খরিদ করে নেবেন এবং খরিদ করেন। মেকপেলাহ মাঠের ওই গুহায়ই কবর হয় বিবি সারাহ, আব্রাহাম, ইছাক, রেবেকা, লিহ ও জেকববা নবী ইয়াকুব এর। আর এই “মেকপেলাহ” জেদ্দায় নয় হেবরণ-এ(ইজরায়েল)।

এটি সুবিদিত যে, আব্রাহামি সময়ের সকল পবিত্র পুস্তক যেমন তোরাহ, বাইবেল’ ও পবিত্র কোরাআন এ বলা আছে আল্লাহ্র সৃষ্টি হুশদার প্রাণীকূলের মাঝে আদম ও হাওয়া ই হলেন প্রথম মানব-মানবী।

যা ই বলিনা কেনো, গল্প বা কিংবদন্তী হলেও এ যে অতি প্রাচীণ, নতুন কিছু নয় এ নিয়ে কোন দ্বিধা কারো মাঝে থাকার কোন কারণ নেই। অন্ততঃ সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার কাহিনী। আজো সমভাবে মানুষের মাঝে চালু আছে। সবচেয়ে চমক লাগানো তথ্য হলো, এখনও জেদ্দার একটি কবর এলাকায় চিহ্ন লিখে রাখা হয়েছে এই বলে যে ঊাবং এৎধাব। যদিও সৌদি রীতি অনুসারে সেখানে কোন পাথর রেখে নিশানা দেয়া নেই। ফলে একেবারে সঠিক করে কবরটি নির্ণয় এখন কঠিন। তবে ওই কবর এলাকায় এখনও জনশ্রুতি আছে যে “ইভ”(তার উপর আল্লাহর শান্তি নেমে আসুক) এর কবর লম্বায় ১২০ মিটার ও পাশে ৩ মিটার প্রশস্ত ছিল। আবার “ট্রিপফ্রিকজ” আর “এনসাক্লোপেডিয়া” এর বর্ণনায় কবরের দৈর্ঘ্য ৪০০ফুট আর প্রস্থ ১১ফুট এবং খুব সম্ভবতঃ ১৯২৮ সালে তা ওয়াহাবিদের হাতে বিনষ্ট হয়ে যায়। ওয়াহাবিরা ১৯৭৫ সালে কংক্রিট দিয়ে ওই কবরের চারপাশ বন্ধ করে দেয়, কেবলমাত্র পবিত্র দর্শনার্থীদের এখানে প্রার্থনা থেকে বিরত রাখার জন্য। “ট্রিপফ্রিকজ” লিখছে ওই কবর গাত্রে লিখা আছে- “আওয়ার মাদার ইভ”। কালের বিবর্তনে এর ক্ষয় হয়েই চলেছে। আবেগী হৃদয়ের মানুষের আÍার শান্তির কথা চিন্তায় রেখে কবরগাত্রে ওই নামফলক লাগানো আছে, যাতে মানুষ তার অন্তরনিহিত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারে।

মানব মনের আবেগ, অনুভুতি আর চিন্তার এ দিক থেকে বিবেচনা করে বলতে চাই “বিবি হাওয়া”র (তার উপর আল্লাহ্র শান্তি নেমে আসুক) কিংবদন্তী হোক আর যাই হোক, কবর বলে এখনও যা আছে ইতিহাসের স্বার্থে প্রাচীণ এ নিদর্শনকে নিরাপদ রাখা সকলের দায়ীত্ব। অত্যানুধিক এই সময়ে যুদ্ধের যে দামামা চারদিকে বেজেই চলেছে তা থেকে এসব অতি মূল্যবান নিদর্শন সমূহকে শক্তভাবে নিরাপদ রাখা গোটা মানবজাতির দায়ীত্ব ও কর্তব্য। আর দুনিয়ার প্রথম মানুষ “আদম ও হাওয়া” (তাদের উপর আল্লাহ্র শান্তি নেমে আসুক), তাদের কবরের নিদর্শন আর তার সংরক্ষন সে তো বিশ্ব মানবতারই গৌরবের বিষয়।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের কক্সবাজার। মোবাইল:- ০১৬১৯০৭০৫১৩