পশ্চিমবঙ্গের বারাসতের অদূরে ভাঙাচোরা এক মসজিদকে দাঙ্গার সময় বাঁচিয়েছিলেন এক হিন্দু পরিবার। সেই থেকে রমজানে তাঁরা নিয়মিত রোজা রাখেন। লিখেছেন ঋজু বসু

মসজিদের পাশে চলতে-ফিরতে কপালে হাত ঠেকান অমুসলমানরা। কেউ কেউ মসজিদের পাশের আদ্যিকালের বাদামগাছটার বাঁধানো বেদিতে মোমবাতি জ্বালান। ইফতারের আগে রাস্তার কল থেকে জল ভরে আনেন কেউ কেউ। পাশেই আম-লিচুর মস্ত বাগান! কিছু দিন হলো সেখানে আবার প্রতিমা গড়ছেন পটুয়া নিশি পাল। নিত্যকার জুমার জমায়েত, মসজিদের ছাদের ইফতার, রমজানের তারাবির নামাজ বা কোরআন-পাঠে তাতে কখনো সমস্যা হয়নি।বারাসতে পশ্চিম ইছাপুর নবপল্লীর এই মসজিদটাই ধ্যানজ্ঞান বোসবাড়ির ছেলে দীপক বসুর। এ তল্লাটে বোসদের ২০-২৫ বিঘা জমি। আজকের বুড়ো কর্তা দীপক বসু কালীপূজায় বাড়িতে উপোস করেন। তবে এই ৬৭ বছরেও রোজ সকাল-বিকেল মসজিদে যাওয়া চাই। সকাল ৭টায় নিজের হাতে মসজিদের মেঝে ঝাড়পোছ করলে তবেই শান্তি। এই বয়সে নিজে রোজা রাখতে পারেন না। কিন্তু তাঁর পুত্র পার্থ ওরফে বাপ্পার ফাঁকির জো নেই।

 

‘ওরা সারা দিন জল স্পর্শ না করে আছে, আমি কী করে খাই!’ ভাবতে ভাবতে কয়েক বছর হলো পার্থও রোজা রাখতে শুরু করেছেন। স্বামীর খেয়ালটুকুকে মর্যাদা দিতে ভোরের সাহরির আগে চা-রুটি করে দিতে রাত দুটোয় ঘুম থেকে উঠছেন পার্থর স্ত্রী পাপিয়া। গত বছর রমজানে ব্যবসার কাজে বেশ কিছু দিন হৃষিকেশে ছিলেন পার্থ। পবিত্র হিন্দু তীর্থেও রোজার রুটিনে নড়চড় হয়নি।

মাস দেড়েক আগে জ্যাঠামশাই মারা যেতে নিয়মমতো ন্যাড়া হয়েছিলেন তিনি। বড়সড় একটা রুমাল মাথায় বেঁধে মসজিদের ছাদে রোজাদারদের কাতারে ইফতারে বসেন পার্থ। চল্লিশের যুবাকে ঠাট্টা করতে ছাড়ে না বন্ধুরা। মজা করে ডাকে, ‘মহম্মদ’ পার্থসারথি বসু! পার্থর তাতে বয়ে গেছে।

বারাসতে দেশান্তরী খুলনার বসু পরিবার অবশ্য কল্পনাও করেনি, তাঁদের ভাগ্যের সঙ্গে এভাবে জড়িয়ে যাবে একটি মসজিদ। ’৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দাঙ্গার আগে কোনো দিন ‘ইন্ডিয়ায় থিতু হব’ ভাবেনইনি কেউ। পার্থর ঠাকুরদা প্রয়াত নীরদকৃষ্ণ বসু পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের হাতের ‘খিদমত-ই-পাকিস্তান’ খেতাবধারী। চট্টগ্রাম বন্দরের গেজেটেড অফিসার ছিলেন। খুলনার ফুলতলার আলকাগ্রামের বোসেদের জীবনে গভীর ঘা রেখে গিয়েছিল তখনকার ঘটনা। নিজেদের বাঁচাতে টানা ১১ দিন দফায় দফায় পুকুরে ডুব দিয়ে মুখটুকু তুলে লুকিয়ে ছিলেন এ বাড়ির ছেলে মৃণালকান্তি। নীরদকৃষ্ণের সেজ ছেলে নারায়ণকৃষ্ণকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকাররা। গলায় দড়ি দেন তাঁর স্ত্রী গৌরী। নীরদকৃষ্ণ ও তাঁর ভাই বিনোদবিহারীর সন্তানরা এর পরেই বারাসতের ওয়াজুদ্দিন মোড়লের বিশাল সম্পত্তি পাল্টাপাল্টি করে এ পারে চলে আসেন।

যে জমির মালিকানা মিলেছে, তাতে যে একখানা মসজিদ রয়েছে, তা অবশ্য গোড়ায় কেউ খেয়াল করেননি। জমির পরচাতেও কিছু লেখা ছিল না। মেরেকেটে তিন কাঠা জায়গা। ভাঙাচোরা পোড়ো মসজিদটা কবেকার কেউ বলতে পারেনি। সাপখোপের ভয়ে কেউ ভেতরেও ঢুকত না তখন। ‘ও রাখা না-রাখা সমান’ বলে মাথা ঘামাতেই চাননি সাবেক মুসলমান মালিকরা। কিন্তু বাদামগাছের ধারের মসজিদে ভক্তিভরে বাতি জ্বেলে নীরদকৃষ্ণের স্ত্রী লীলাবতীর মনটাই অন্য রকম হয়ে গেল। ‘এ মসজিদে বাতিধূপের যেন অভাব না হয় বাবা,’ ছেলেদের বলেছিলেন তিনি।

গুটিকয়েক মানুষের অত্যাচারের জন্য একটা গোটা ধর্ম ও তার মানুষদের দোষ দিতে পারব না। কিছু মানুষের বিশ্বাসের স্মারক ধর্মস্থানের অমর্যাদা হতে দেওয়াও তো সম্ভব নয়!—এটাই ছিল নীরদকৃষ্ণের জীবনদর্শন। বোসদের হাতে মসজিদ তাই নতুন প্রাণ পেল। নিজেরা কখনো ধর্ম পাল্টানোর কথা ভাবেননি। বিশ্বাসী হিন্দু পরিবার নিজের ধর্মাচরণ বজায় রেখেছে। শুধু ক্ষুদ্রতাকে প্রশ্রয় দেননি তাঁরা।

‘লোকদেখানো বাড়াবাড়ি মানি না। এটুকু বুঝি, একসঙ্গে জড়িয়ে বাঁচায় সমস্যা নেই!’—স্মিত হাসেন পার্থর বাবা দীপকবাবু। ধীরে ধীরে সাধ্যমতো মসজিদ সংস্কারের পথে হেঁটেছেন বসুরা।

মসজিদের গায়ে বড় হরফে লেখা, ‘প্রভুকে প্রণাম করো’! তার পাশে, ‘আমানতি মসজিদ’। এই বসু পরিবার আবার চট্টগ্রামের আমানত আলী শাহের মুরিদ।

বসুদের পারিবারিক সংস্কৃতির সঙ্গেও ক্রমে একাকার এ মসজিদ। এ বাড়ির কেউ মারা গেলে তাঁকে একবার ঠিক নিয়ে আসা হবে এখানে। শ্মশানে শেষযাত্রার আগে আজান দেবেন ইমাম সাহেব। বিয়ের পরে নতুন বউকেও শ্বশুরবাড়ি ঢোকার আগে মসজিদে প্রণাম করতে আসতে হবে। আর এ বাড়িতে নবজাতকের অন্নপ্রাশনের দস্তুর নেই। তার বদলে মসজিদে ইমাম সাহেবের হাতে একটু পায়েস মুখে দেওয়ার রীতি। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষের উসকানির কাছে হার না-মানা পারিবারিক মূল্যবোধেরও আমানত এই মসজিদ-প্রাঙ্গণ।

আড়াই দশক আগে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ নিয়ে তখন তোলপাড় গোটা দেশ। পার্থ, তাঁর জেঠতুতো দাদা-ভাইরা ভরসন্ধ্যায় দল বেঁধে মসজিদেই পড়ে থেকে পাহারা দিতেন। রাজনীতির ঝড়বাদলের কোনো অভিঘাত এখানে ছাপ ফেলতে পারেনি। দীপকবাবু কেরোসিনের ডিলার। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যৎসামান্য টাকা রেখে এখনো বারো আনাই উজাড় হয় মসজিদের যত্নে। এই বোসবাড়িরই ছেলে বম্বের প্রয়াত ফিল্ম ডিরেক্টর দিলীপকুমার বসু। তুতো ভাইরা মিলে ভাগাভাগি করে মসজিদের চেহারা ফিরিয়েছেন। ইমাম, মুয়াজ্জিনদের ডেকে এনে বসানো হয়েছে। সংকট-সমস্যায় হিন্দুরাও আসে। কিন্তু কবচ-তাবিজ বিক্রির কোনো প্রশ্ন নেই।

‘বিশ্বাস বিশ্বাসের জায়গায় থাকুক! ধর্মব্যবসা কিন্তু হতে দেব না’—জোর গলায় বলেন দীপকবাবু। অনেক বছর আগে তাবিজ-মাদুলি বিক্রির দোষে এক ইমামকে বরখাস্তও করেছিলেন বসুরা। তিনি পাল্টা ঘোঁট পাকাতে গেলে ‘বোসবাড়ির মসজিদ’ শুনে কেউ সে অভিযোগে আমলই দেননি।

কেউ যাতে আঙুল তুলতে না পারে, তাই এ মসজিদে অনুদান গ্রহণেরও নিয়ম নেই। একটি প্রভাবশালী ধর্মীয় সংগঠন একবার মসজিদের দায়ভার নেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। বসুরা তাঁদের বসিয়ে চা খাইয়েছেন। আর ‘এই প্রাণের মসজিদ কী করে ছেড়ে থাকব’—সবিনয় নিজেদের অপারগতাটুকু বুঝিয়েছেন।

ইফতারেও রাজনীতির ছোঁয়া লাগার জো নেই। কোনো নেতা-নেত্রীকে ডাকা হয় না। ‘ইফতার-পার্টি’ শব্দটাতেই ঘোর অ্যালার্জি পার্থর। ‘ইফতারের আবার পার্টি কী? এখানকার রোজাদারদেরও জাঁকজমক ভরা মোচ্ছব এড়িয়ে চলতেই অনুরোধ করা হয়!’

ইফতারের সময় তবু আনন্দের হাট বয়ে যায়। ফি সন্ধ্যায় ইমামের কোরআন পাঠের আসরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ভিড়। পার্থ বলেন, ‘আমরা মানি, কোরআন কিন্তু শুধু মুসলিম নয়, সবার পড়ার জন্য!’ সাতাশের রোজার দিন পড়া সম্পূর্ণ হলে সাধ্যমতো চাঁদা তুলে পাড়ার সবাইকে মাছ-ভাত খাওয়ান নিয়মিত রোজাদাররা। বিকেলে ইমাম আখতার আলী আসেন মোটরবাইক হাঁকিয়ে। সন্ধ্যায় তারাবির নামাজ শুরুর আগে মসজিদে বসে এক প্রস্থ মাছ-ভাত খেয়ে ওঠেন। কিন্তু পিতৃপ্রতিম দীপকবাবু আশপাশে থাকলে, তাঁর মুশকিল। এক টিপ মুখে দিতেও আখতারভাইকে আড়াল খুঁজতে হবে। ধরা পড়লে বকুনি। সবার গার্জেন দীপকবাবুর স্নেহের শাসন জারি থাকে সারাক্ষণ।

ধর্ম-রাজনীতির খোপকাটা যাপন এখানে অবান্তর! বারাসতের অখ্যাত মহল্লায় তিন কাঠার জমির ভারতবর্ষ নিরন্তর বলে চলেছে, ‘একসঙ্গে বাঁচবই। ’

 

আনন্দবাজার থেকে, ঈষৎ সংক্ষেপিত