মহসীন শেখ

আরবের প্রায় সবদিকে প্রচন্ড গরম। স্বাভাবিকভাবে গরমে প্রতিনিয়ত সৌদিআরবের তাপমাত্রা উঠানামা করে ৪০ থেকে ৫০ডিগ্রী সে.। সেখানকার প্রতিটি বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে যে কোন স্থাপনাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এককথায় বলতে গেলে ঘরের বাহিরে গেলেই গা জ্বলে যাবে। তাই মেহমানকে সর্বপ্রথম আতিতিয়তা করা হয় ঠান্ডা পানি দিয়ে। মেহমানের শ্রেণী যাই হোক ঠান্ডা পানিতেই স্বস্তি। প্রচন্ড এ গরমে একটু স্বস্তির জন্য সৌদি নাগরিক ছাড়াও হাজী থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই ছুটে যায় শৈল শহর অথবা ঠান্ডার শহর তায়েফে।

তায়েফ মক্কা প্রদেশে অবস্থিত একটি শহর। পবিত্র মক্কা থেকে মাত্র ৯০ কি.মি. দূরত্বে শৈল শহর তায়েফ। সমুদ্র সমতল থেকে এর উচ্চতা ১৮৮৯ মিটার। জনসংখ্যা ৫২১,২৭৩ জন। হজ্জে গেলে সেদিকে যাওয়া কষ্টকর তবে ওমরাহ্ করতে গেলে সেখানে যেতে কোন বাঁধা নাই।

অস্বস্তিকর এ গরমে একটু স্বস্তির আশায় গত ২২মে সকাল ১১টার দিকে বন্ধু শাহনেওয়াজ সিকদার তার পরিবারকে সহ আমি এবং আমার সহধর্মীনীকে নিয়ে যায় তায়েফে। সেখানে বিশাল আকৃতির পাহাড়ে ১ ঘন্টা ২০ মিনিটের মধ্যে পাহাড় কেটে রিং আকারে তৈরি করা প্রায় ৯৫ কিলোমিটার রাস্তা শেষ করে চূড়ায় তায়েফে এসে পৌঁছলাম। পাহাড় বেয়ে চুঁড়ায় উঠতে দেখা যায় হাজার হাজার বানর। মনে অতিথিকে স্বাগত জানাচ্ছে তাদের প্রিয় ঠান্ডার শহরে। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে বানকে খাবার ছুড়ে মারছে। সেলফি তুলছে পরিবার নিয়ে। আবার অনেকেই রাস্তার পাশে বিভিন্ন গাছের নিছে বসে খাবার খাচ্ছে। আবার অনেকেই বিশ্রাম নিচ্ছে। তায়েফ শহরের রাস্তার দু’পাশে কিছু দূর পর পরই তাজা ফলের দোকান। সস্তা দরেই ফল বিক্রি হয়। আমরাও অন্যান্যদের মতো শহরটির একটি নির্জন স্থানে অবস্থান নিয়ে সেলফি তুলেছি যে যার ইচ্ছে মতো। বিশ্রাম করেছি পরিমাণ মতো। সেখানে সাথে নিয়ে যাওয়া খারার খেয়েছি দুপুরে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্তই অবস্থান করে প্রচন্ড স্বস্তি অনুভব করেছি তায়েফ শহরে।

আরবের অন্যান্য স্থান থেকে তায়েফের আবহাওয়া মক্কার পুরো উল্টো। এখানে শীত, ওখানে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চারিপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে আমরা অভিভুত। সে কি প্রাকৃতিক সৌন্দর্ষ্য, যা বলার ভাষা থাকেনা। সবদিকে প্রচন্ড গরম আর এক ঘন্টার দূরত্বের এ শহরে ঠান্ডা। পাহাড়ের উপর উঠে দেখে মনে হয় একটি শান্তির শহর। পৌঁছে আমরা পাহাড়ে নিচে অবস্থিত মানুষের বসবাস সহ দূর থেকে বিভিন্ন মনোরম দৃশ্য অবলোকন করি। যতই দেখি মন জুড়িয়ে যায়।

আসলেই মহান সৃষ্টিকর্তার কেরামতি বুঝার সাধ্য কারো নেই তা তায়েফ শহরে গিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো।

তথ্যমতে, বাদশা ফয়সাল ও বাদশা খালেদের আমলে শীতকালীন রাজধানী হিসেবে গণ্য করা হতো। বাদশা খালেদের আমলে এখানে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শীতকালে এখানে কখনও কখনও পানি জমাট বেঁধে যায়। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় তায়েফ। রবিশস্য ও নানান ফল-ফলাদির জন্য তায়েফ বিখ্যাত। প্রাচীনকাল থেকে পবিত্র মক্কার সাথে নিবিড় স¤পর্ক ছিল। উষ্ণ মরুভূমিপ্রবণ পবিত্র মক্কাবাসী খাদ্যদ্রব্য পেতে তায়েফের উপর নির্ভরশীল ছিল। অপরদিকে তায়েফবাসীও পবিত্র মক্কায় খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করে লাভবান হতো। সেকালেও পবিত্র মক্কার ধনীরা বিশেষ করে স¤পদশালীরা গরমকাল তায়েফে কাটিয়ে আসতো। পবিত্র মক্কার বনী ওমাইয়া তায়েফে জমি খরিদ করে। অপরদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে তায়েফের অনেকে পবিত্র মক্কায় বসতি স্থাপন করতো।কুরআনুল করিমে পবিত্র মক্কা ও তায়েফ একত্রে মিলিত করে শহরদ্বয় বলা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে তায়েফ সব সময় পবিত্র মক্কার পক্ষে থাকতো। নবী পাক (স.) পবিত্র মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত তায়েফবাসী ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তথা আবু লাহাব, আবু জাহেল আবু সুফিয়ানের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। পবিত্র মদিনায় উহুদ যুদ্ধে ও পরিখার যুদ্ধে তায়েফে কিছু অধিবাসী পবিত্র মদিনায় গিয়ে ইসলামের শত্রুদের সাথে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করেছিল।

নবী পাক (স.) ইসলামের দাওয়াত দিতে তায়েফে গমন করেছিলেন। কিন্তু তায়েফবাসী কর্তৃক তাঁর প্রতি অমানবিক, বর্বরোচিত নির্যাতন ইসলামের ইতিহাসে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। আবু তালেবের ইন্তেকালের পর কুরাইশদের পক্ষ হতে নবী পাক (স.) এর প্রতি নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তিনি ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের জন্য ভিন্ন ক্ষেত্র সন্ধান করতে থাকেন। তারই এক পর্যায়ে তিনি তায়েফ গমন করেন। তবে নবী পাক (স.) একা গমন করেছিলেন না তাঁর সঙ্গে সফর সঙ্গী হিসেবে কেউ ছিলেন এ স¤পর্কে দু’ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। এক বর্ণনায় নবী পাক (স.) এর সাথে হযরত

জায়েদ বিন হারিছা (র.) সঙ্গে ছিলেন বলে বর্ণনা রয়েছে।

নব্যুয়াতের দশম বর্ষে শাওয়াল মাসে তায়েফ গমন করেছিলেন। তায়েফ পৌঁছে ছাকীফ গোত্রের লোকদের নিকট গেলেন। কিন্তু তারা নবী পাক (স.) এর আহ্বানে সাড়া দিলেন না উল্টো নানান তিরষ্কার, অসদাচরণ শুরু করেছিলেন এবং তায়েফের লোকজন ছেলেরা নবী পাক (স.) এর প্রতি নানান তিরষ্কারসহ আক্রমণাত্বক আচরণ শুরু করে। নবী পাক (স.) দশদিন মতান্তরে এক মাস তায়েফে অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তিনি তায়েফের নেতৃস্থানীয় সকলের নিকট দাওয়াত পৌঁছে দিলেন, কাউকে বাকি রাখলেন না। কিন্তু তারা কেউ দাওয়াত তো গ্রহণ করলো না উল্টো বেকুব ও দাসদের লেলিয়ে দিল।

মূসা ইবনে উকরা বর্ণনা করেন, নবী পাক (স.)তায়েফের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পাথর মারাসহ নানাভাবে আক্রমণ করেন। এতে নবী পাক (স.) এর পাদ্বয় রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। হযরত জায়েদ ইবনে হারিছা (র.) নিজের জীবন দিয়ে নবী পাক (স.) এর জীবন রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কথিত আছে একস্থানে নবী পাক (স.) আহত হয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বিশ্রাম নেওয়া অবস্থায় বিধর্মীরা পাহাড়ের ওপর থেকে টন টন আকারের একটি বৃহৎ পাথর নবী পাক (স.) এর গায়ের উপর ঠেলে দেয়। নবী পাক (স.) হাতের কনুই দিয়ে এ বিশাল পাথরটি আটকিয়ে দেন। বর্তমানে এ স্থানে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। তায়েফ গমন করলে মুসলিমরা এ মসজিদে বরকতের জন্য নামাজ পড়ে থাকেন। তায়েফের এ দুঃখজনক ঘটনার পর আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে ফেরেশতার মাধ্যমে তায়েফবাসীকে কঠিন শাস্তির কথা জানালে রহমতুল্লীল আল লামীন নবী পাক (স.) এতে সম্মত হননি।

পবিত্র মক্কা বিজয়ে তায়েফবাসী খুশি না হয়ে নিরাশ ও মর্মাহত হন। পবিত্র মক্কা ইসলামের ছায়াতলে এলেও তায়েফ নবী পাক (স.) এর বিরোধিতায় অনড় থাকে। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, পবিত্র মদিনা থেকে ইসলামের জাগরণ ব্যাপকরূপ লাভ করতে থাকে তখন তায়েফ ইয়ামেনসহ ছোট বড় সকল অঞ্চল পবিত্র মক্কার বিধর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে। তাদের বিশ্বাস পবিত্র মক্কা ইসলামের ছায়াতলে চলে গেলে জজিরাতুল আরবের অন্যান্য অঞ্চল অনায়াসে ইসলামের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। পবিত্র মক্কা বিজয়ের পর তায়েফ সহজেই আনুগত্য স্বীকার না করতে অনড়। ফলে একে কেন্দ্র করে হুনায়নে প্রথম যুদ্ধ বাধে। ফলে এ ধারা তায়েফেও অব্যাহত থাকে। কয়েক সপ্তাহব্যাপী তায়েফ অবরোধ থাকে। নবী পাক (স.) অবরোধের গতি না বাড়িয়ে সেখানে মধ্যস্থতার চাপ সৃষ্টির জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করেন। এতে এক বছর না যেতেই তায়েফবাসী ইসলাম কবুল করে নেয়। হযরত আব্বাস (র.) এর সাথে তায়েফের ব্যবসা-বাণিজ্যের স¤পর্ক ছিল। পরবর্তীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (র.) তায়েফের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যান। তায়েফের প্রধান মসজিদকে ইবনে আব্বাস মসজিদ বলা হয়। এ মসজিদ সংলগ্ন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (র.) চিরনিদ্রায় শায়িত। তায়েফ অবরোধ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কবর এ মসজিদ সংলগ্ন দেয়ালের বাইরে। শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, তায়েফে একাধিক স্থানে সাহারার কবর বিদ্যমান।

তুর্কি শাসন আমলে পবিত্র মক্কার তুর্কি গভর্নর তায়েফেই গ্রীষ্মকাল কাটাতেন। ১৯২৪ ইংরেজির এপ্রিলে শরীফ হোসাইনের সাথে যুদ্ধ করে বাদশা ফয়সাল এর নেতৃত্বে আবদুল আজিজ তায়েফ দখল করে। তৎপরবর্তী হতে সৌদি সরকার তায়েফকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এখানেই সৌদি আরবের গ্রীষ্মকালীন শহর হিসেবে অনেক কিছু নির্মিত হয়েছে। নির্মিত আছে আন্তর্জাতিকমানের বিমান বন্দর। বাদশা ফয়সাল ও বাদশা খালেদ গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে তায়েফকে গুরুত্ব দিতে পারলেও বাদশা ফাহাদের পক্ষে তা তেমন সহজ হয়নি। হয়তো বা অতি ব্যস্ততার কারণে। বাদশা আবদুল্লাহ বার্ধক্যের চাপে ভারাক্রান্ত ছিলেন। তারপক্ষেও গ্রীষ্মকালীন রাজধানী গমন করা বা অবস্থান করা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলশ্রুতিতে তায়েফ সৌদি আরবের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে বলা যাবে।

সৌদি সরকার তাদের বিশাল দেশে আকাশ যোগাযোগের পাশাপাশি সড়ক যোগাযোগে ধারণাতীত উন্নতি লাভ করেছে। ফলে তায়েফের সাথে পবিত্র মক্কা ও রিয়াদসহ একাধিক দিক দিয়ে উন্নত সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। তায়েফে উৎপন্ন আক্সগুর, কমলা, আনার ইত্যাদি অতি দামী ফলফলাদি মিষ্টি পুষ্টিতে ভরপুর। বিশেষ করে তায়েফের আংগুর বিখ্যাত।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের কক্সবাজার। মোবাইল:- ০১৬১৯০৭০৫১৩