ইমাম খাইর, সিবিএন
ঘূর্ণিঝড় মোরার ধকল কেটে না ওঠতেই বিপদে পড়ে গেল দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া। গত সপ্তাহের তীব্র ঝড়ো হাওয়া এবং পূর্ণিমার ভরা জোয়ারে ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। ইতোপূর্বে দ্বীপের ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩০ কিলোমিটারের বেশী বিধ্বস্ত হয়। বাড়ীঘরে ঢুকে পড়ছে জোয়ারের পানি। লোনা পানিতে ডুবে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ফসলের বীজতলা, পুকুরের মাছ ও রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে জনবসতি। টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে টিকে থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন দ্বীপের দেড় লাখ মানুষ। হুমকিতে পড়েছে দেশের একমাত্র বায়ুবিদ্যুত প্রকল্পটিও।

উপজেলার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের পশ্চিম আলী আকবর ডেইল, কাহার পাড়া, কাজীর পাড়া, কিরন পাড়া, চৌধুরী পাড়া, পন্ডিত পাড়া, তেলি পাড়া, হায়দার বাপের পাড়া, পূর্ব তাবালেচর, পশ্চিম তাবালেরচর, জেলে পাড়া এবং বড়ঘোপ ইউনিয়নের মুরালিয়া, রোমাই পাড়া এলাকায় জোয়ারে বেড়িবাঁধ বিলিন হয়ে কয়েক হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে গেছে।

উত্তর ধুরুং এলাকার কাইছারপাড়া, চুল্লারপাড়া, চরধুরুং, নয়াকাটা, আকবর বলীপাড়া, ফয়জানির বাপের পাড়া, উত্তর সতর উদ্দিনসহ অন্তত ১০ গ্রাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। বড়ঘোপ আজম কলোনী, মধ্যম অমজাখালী, দক্ষিণ অমজাখালী এলাকায় ঘূর্নিঝড় রোয়ানুর সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়।

কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম নুরুল বশর চৌধুরী কক্সবাজার নিউজ ডট কম (সিবিএন)কে জানান, আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের কাহারপাড়া থেকে তাবালেরচর পর্যন্ত দীর্ঘ ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে।

উদ্বিগ্ন দ্বীপের মানুষ।

বড়ঘোপ ইউনিয়নের মুরালিয়া গ্রামের পূর্ব পার্শ্বের ১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের কায়ছারপাড়া থেকে পশ্চিমচর ধুরুং পর্যন্ত ১ কিলোমিটার এবং মিয়ারা কাটা থেকে দক্ষিণে পুরাতন বাতিঘর পর্যন্ত ২ কিলোমিটার সাগরের সাথে মিশে গেছে।

তিনি জানান, দ্বীপ উপজেলার দেড় লক্ষাধিক মানুষের স্বাভাবিক বসবাস ও জানমাল রক্ষার্থে জরুরী ভিক্তিতে বেড়িবাঁধ পূণঃনির্মাণ, জিও ব্যাগ দিয়ে মেরামতসহ স্থায়ী বেড়িবাঁধ জরুরী। অন্যথায় ইতিহাস থেকে কুতুবদিয়া নামক এই দ্বীপটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কাজিরপাড়ার পঞ্চাশোর্ধ দিলুয়ারা সিবিএনকে জানান, জোয়ারের পানিতে তার বসতবাড়ী ভেঙে গেছে। ভাঙা ঘরের ভেজা মাটিতে ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে কষ্টের দিন যাচ্ছে তাঁর। স্বামীহারা দিলুয়ারার সংসারে এখন অন্ধকার। জীবন ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ে দিন যাপন করছে। অনেকটা অর্থের ভিখারী। ইটের চুল্লি বানিয়ে কোন রকম রান্নাবান্না সারছে। যন্ত্রণার জীবনমুক্ত হতে সবার কাছে আকুতি জানায় দিলুয়ারা। একই কথা ধলুয়ারা, খালেদা, ছেনুয়ারা, মিনুয়ারা, বুলবুল আকতার, শাফিয়া, ফাতেমা, ফরিদা, পারুল, মরতুজা, কামরুন নেছার। তাদের বর্ণনা ওঠে আসে দুঃসহ জীবনের কথা।

সুত্র জানায়, গত ২১ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ ৩০ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ কুতুবদিয়া দ্বীপে মারাতœক আঘাত হানে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেড়িবাঁধ। যথা সময়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার/পুননির্মাণ ব্যবস্থা না নেয়ায় ১১ জুন দিবাগত রাতের পুর্নিমার জোয়ারে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়। ভেসে যায় বাড়ীঘর। লবন পানিতে নষ্ট হয়ে যায় ক্ষেত খামার।

ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু’র আঘাতে ভাঙা পয়েন্ট দ্রুত সংস্কারের জন্য ১০কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এক বছরে কাজে হাত দেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাওবো)। ফলে চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই জোয়ার-ভাটায় সাগরের সাথে একাকার হয়ে গেছে অরক্ষিত কুতুবদিয়ার জনপদ।

সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে গত রবিবার (১১জুন) থেকে একটানা প্রবল বর্ষণ, ঝড়ো হাওয়া এবং পূর্ণিমার ভরা কাটাল (জোয়ার)-এ সাগরের পানি স্বাভাবিকের তুলনায় ৩/৪ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয় উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রাম। ফসলের বীজতলা বিনষ্ট হয়ে দ্বীপের চাষযোগ্য প্রায় ১৪০হেক্টর জমিতে আউশের চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে আলী আকবর ডেইলে গেলে হকদার পাড়া সড়কটি পানির ধাক্কায় লন্ড ভন্ড হয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। ওই ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের তেলী পাড়া থেকে ১নং ওয়ার্ডের ঘাটকুল পাড়া পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এ সংযোগ সড়কটির পূর্বাংশ পিচ ঢালাই হলেও পশ্চিমাংশে (হকদার পাড়া) ৩০মিটার এখনো ব্রিকসলিন। গেল অর্থবছরে (২০১৬-১৭) এলজিএসপি ২-এর অর্থায়নে সড়কটি পুনঃসংস্কারের কাজ শেষ হয় মাত্র। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মোরাসহ সম্প্রতি সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে প্রবল বর্ষণ ও জোয়ারে প্লাবিত হয়ে ওই সড়কটি সম্পুর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ঘাটকুল পাড়া, নয়া পাড়া, হকদার পাড়া, তেলী পাড়াসহ পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এ সড়ক। মানুষের দূর্ভোগ লাঘবে জনগুরুত্বপূর্ণ সড়কটি দ্রুত মেরামতের দাবী জানিয়েছে এলাকাবাসী।

কুতুবদিয়া-পেকুয়া-চকরিয়া এলাকায় দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়নবোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (বান্দরবান) শফিকুল ইসলাম শেখ কক্সবাজার নিউজ ডট কম (সিবিএন)কে জানান, পুরো দ্বীপে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য ৯২ কোটি টাকার সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু করা হবে।