মাহে রমজানে যে সব আমল দ্বারা বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হয়, তন্মধ্যে মাহে রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফ অন্যতম। ইতেকাফ শব্দের অর্থ স্থির থাকা, আবদ্ধ থাকা, অবস্থান করা। শরীয়াতের পরিভাষায় মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন বা যে কোনো দিন দুনিয়ার সব কাজ-কর্ম তথা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদে বা ঘরের পবিত্র স্থানে ইবাদতের নিয়তে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘তোমরা মসজিদে ইতেকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হবে না।’ (সূরা বাকারা: ১৮৭)

ইতেকাফের জন্য কিছু শর্ত রয়েছে, তা হলো—

১. পুরুষ লোক জামে মসজিদে ইতেকাফ করবে আর মহিলারা ঘরের নিভৃত স্থানে ইতেকাফ করবেন।

২. ইতেকাফের নিয়ত করতে হবে।

৩. সর্বদা পাক-পবিত্র থাকতে হবে।

৪. রমজানের ইতেকাফকারী রোজাদার হবেন।

ইতেকাফ তিন প্রকার—

১. সুন্নাত ইতেকাফ: রমজানুল মুবারকের শেষ ১০ দিনের ইতেকাফই সুন্নাত। ২১ তারিখের রাত থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এই ইতেকাফের সময়। কারণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর এই দিনগুলোতেই ইতেকাফ করতেন। এ কারণে এটাকে সুন্নাত ইতেকাফ বলা হয়।

২. ওয়াজিব ইতিকাফ: মান্নতের ইতেকাফ ওয়াজিব। ইবনে উমর রা. নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি জাহেলী যুগে হারাম শরীফে ইতেকাফের মান্নত করেছিলাম, এখন কী করব?’ নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, তুমি তোমার মান্নত পূরণ করো। (বুখারী) তাছাড়া সুন্নাত ইতেকাফ ভঙ্গ হয়ে গেলে তা কাজা করা ওয়াজিব।

৩. নফল ইতেকাফ: এ ইতেকাফ মানুষ যে কোনো সময় করতে পারে। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য ইতেকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যতক্ষণ চায় করতে পারে। রোজারও প্রয়োজন নেই। এমনকি যখনই মসজিদে প্রবেশ করবে নফল ইতেকাফের নিয়ত করা সুন্নাত। এই তিন ধরনের ইতেকাফের ভিন্ন ভিন্ন বিধান আছে।

আজ আমরা শুধু সুন্নাত ইতেকাফের কিছু বিধান আলোচনা করব।

সুন্নাত ইতেকাফকারীদের ২০ রমজানের সূর্যাস্তের আগে মসজিদের সীমানায় প্রবেশ করতে হবে এবং ২৯ বা ৩০ রমজান পরবর্তী মাস তথা শাওয়ালের চাঁদ দেখে মসজিদ থেকে বের হতে হবে। রমজানের শেষ ১০ দিনের ইতেকাফ সুন্নাতে মুআক্কাদা কিফায়া। অর্থাৎ মহল্লার যে কোনো একজন ইতেকাফ করলে পুরো মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে ইতেকাফ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু মহল্লার একজন ব্যক্তিও যদি ইতেকাফ না করে, তবে মহল্লার সবার সুন্নাত পরিত্যাগের গোনাহ হবে। (শামী)

রমজানের শেষ দশকে এই সুন্নাত ইতেকাফের অধিক গুরুত্বের কারণ হলো লাইলতুল কদরের নেকি লাভ করতে হলে ইতেকাফের মাধ্যমেই সহজে করা যায়। কারণ ইতেকাফকারী রমজানের শেষ দশকের সব রজনীতেই আমলে মগ্ন থাকেন। কোনো এক রজনী তো কদর হবেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি লাইলাতুল ক্বদরের সৌভাগ্য ও এ মহিমা অনুসন্ধানে প্রথম ১০ দিন ও মাঝের ১০ দিন ইতেকাফ করেছি। অবশেষে আমার কাছে একজন ফেরেশতা এসে বলেছে যে, তা শেষ দশকে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যারা ইতেকাফ করতে চায়, তারা যেন শেষ দশকে ইতেকাফ করে।’ অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সাথে শেষ দশকে ইতেকাফ করলেন। (মুসলিম: ২৮২৮)

আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদা-সর্বদা রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। এমনকি তাঁর ওফাত হয়ে গেলে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীগণ ইতেকাফ করেন। (বুখারী: ১৮৮৬) শবে কদরকে পাওয়া এবং এই পবিত্র রাতের ঘোষিত ফজিলত থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য ইতেকাফ থেকে উত্তম আর কোনো উপায় নেই। কারণ আল্লাহ তায়ালা কদরের রাতকে নির্দিষ্ট করে দেননি; বরং এর তারিখ গোপন রেখেছেন। যাতে মুসলমানরা রমজানের শেষ ১০ দিনের সব বেজোড় রাতে রাত জেগে আমল করতে থাকে।

স্বাভাবিকভাবে মানুষের পক্ষে রাতের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদতে নিয়োজিত থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু ইতেকাফ অবস্থায় যদি রাতে ঘুমিয়েও থাকে, তবু তাকে ইবাদতকারীদের মধ্যে শামিল করা হবে। তখন শবে কদরের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদতে ব্যয় করার ফজিলত অর্জন করবেন। লাইলাতুল কদর তালাশের পাশাপাশি ইতেকাফকারীর জন্য তার আত্মশুদ্ধি হাসিল করা, আল্লাহ পাকের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা, পৃথিবীর সবকিছুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মাবুদের একচ্ছত্র ইবাদত করার উদ্দেশ্য থাকতে হবে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ইতেকাফকারী গোনাহ থেকে মুক্ত থাকে। তার সব নেক আমল এমন ভাবে লিপিবদ্ধ করতে থাকে, যেভাবে তিনি নিজে করতেন। (ইবনে মাজাহ: ১৭৮১) অর্থাৎ সে ইতেকাফের বাইরে থাকতে যে সব ভালো কাজ আনজাম দিত, যা সে ইতেকাফ থাকার কারণে করতে পারছে না, সেসব আমল আগের মতোই লিপিবদ্ধ হতে থাকে।

ইতেকাফের সবচেয়ে বড় রুকন হলো ইতেকাফের পুরো সময় মসজিদের সীমানায় অবস্থান করা। শরীয়তস্বীকৃত বাধ্যবাধকতা ছাড়া মসজিদের সীমানা থেকে বাইরে না যাওয়া। শরীয়তস্বীকৃত প্রয়োজন ছাড়া মসজিদের সীমানার বাইরে সামান্য সময়ও অবস্থান করলে ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। শরীয়াহ মতে, জরুরত হলো যে সব প্রয়োজন পূরণে ইতেকাফকারীকে মসজিদ থেকে বের হওয়ার জন্য শরীয়ত অনুমতি দিয়েছে। যেমন প্রস্রাব-পায়খানা। যদি মসজিদে অবস্থানকালে গোসল করা সম্ভব না হয়। যদি মসজিদে অবস্থান করে ওজু করা সম্ভব না হয়। খাওয়া-পরার জিনিস বাইরে থেকে আনা লাগে। যদি এনে দেওয়ার মতো লোক না থাকে। মুয়াজ্জিনের আজান দেওয়ার জন্য বাইরে যাওয়া লাগে। যে মসজিদে ইতেকাফ করা হচ্ছে, সে মসজিদে যদি জুমার ব্যবস্থা না থাকে, তবে জুমা আদায়ের জন্য অন্য মসজিদে যাওয়া। মসজিদ ভেঙে যাওয়া ইত্যাদির কারণে অন্য মসজিদে স্থানান্তরিত হওয়া। এসব প্রয়োজনীয়তা ছাড়া ইতেকাফকারীদের জন্য বাইরে যাওয়া নাজায়েজ এবং এতে ইতেকাফ ভেঙে যাবে।

যেসব প্রয়োজনীয়তার কথা ওপরে উল্লেখ করা হলো, এসব ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ইতেকাফকারী মসজিদের সীমানা থেকে বের হলে তা এক মুহূর্তের জন্য হলেও ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (হেদায়া) সেটা ইচ্ছায় হোক বা ভুলক্রমে। তবে ভুলক্রমে হলে ইতেকাফ নষ্ট করার গোনাহ হবে না। (শামী) রোজা ইতেকাফের জন্য শর্ত। যদি কেউ ইতেকাফ অবস্থায় রোজা ভেঙে দেয়, হোক তা কোনো ওজর বা অপারগতার কারণে, ইচ্ছায় বা ভুলক্রমে, ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (শামী ও দুররুল মুখতার) কোনো ইতেকাফকারী কোনো প্রয়োজনীয়তার কারণে বাইরে গেছেন, কিন্তু প্রয়োজন সেরে বাইরেই কিছুক্ষণ অবস্থান করলেন, তাতেও ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (শামী)

ইতেকাফকালীন বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করার পাশাপাশি নফল নামাজ, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার, দোয়া-দরুদ, দান-সদকা ইত্যাদি নফল আমলের প্রতি মনোযোগি হওয়া উচিত। কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ ও অনর্থক গল্প-গুজব বা বেহুদা কথাবার্তা বলে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। দুনিয়ার কোনো লেনদেন না করার পাশপাশি বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়াও উচিত নয়।

মা আয়েশা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘ইতেকাফকারীর জন্য সুন্নাত হলো, রোগির সেবা করতে বের হবে না, জানাযায় শরীক হবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না, রোজা ছাড়া ইতেকাফ নেই এবং জামে মসজিদ (তথা যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতে পড়া হয়) ছাড়াও ইতেকাফ নেই।’ (আবূ দাউদ: ২৪৭৫)