ইমাম খাইর, সিবিএন
জেলাব্যাপী প্রবল ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে। রোববার রাত ৯টা থেকে শুরু হওয়া দমকা হাওয়া গতকাল রাত অবধি অব্যাহত ছিল। অবিরত বর্ষণে শহর ও শহরতলীর অসংখ্য দোকানপাট, কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শহরের প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে গাছ ভেঙ্গে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বৈদ্যুতিক তার ছিড়ে সম্পূর্ণ বিদ্যুতবিহীন হয়ে পড়ে পুরো জেলা। এমনকি বিদ্যুত না থাকায় কক্সবাজারে কোন স্থানীয় পত্রিকা বের হয়নি।

জেলা শহর ছাড়াও সদরের গোমাতলী, পোকখালী, দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও টেকনাফের শাহপরীদ্বীপে পূর্ণিমার জোয়ারে পানি বৃদ্ধি ও প্রবল বর্ষণে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মৌসুমী বায়ুতে প্রবল বেগে দমকাসহ ঝড়ো হাওয়ার প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে জেলার ৮ উপজেলার ২৮টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। জেলার অধিকাংশ নিম্নাঞ্চলে ৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। কক্সবাজার বঙ্গোপসাগর উপকূলে এতে উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে ভাঙন এবং প্লাবিত হয়ে দুই শতাধিক পানের বরজ, শত শত একর রবিশস্য, শতাধিক চিংড়ি ঘের এবং প্রায় এক হাজার বসতবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

সেন্টমাটিনে দমকাসহ ঝড়ো হাওয়া ও জলোচ্ছাসে প্রায় ১২টি কাচাঁবাড়ি সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। সেন্টমার্টিনের সাথে টেকনাফ নৌ পথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে দমকা হাওয়া সঙ্গে পূর্ণিমার ‘জো’ মিলে প্রবল জোয়ারে সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে ভাঙ্গা বেড়িবাধ দিয়ে সাগরের পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় প্রায় ১ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেক এলাকায় বাঁধের বিভিন্ন অংশে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

বিশেষ করে কুতুবদিয়া অধিকাংশ এলাকায় হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি ছাড়াও রবিশস্য, পুকুর ও চিংড়ি ঘের প্লাবিত হয়ে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের পশ্চিম আলী আকবর ডেইল, কাহার পাড়া, কাজীর পাড়া, কিরন পাড়া, চৌধুরী পাড়া, পন্ডিত পাড়া, তেলি পাড়া, হায়দার বাপের পাড়া, পূর্ব তাবালেচর, পশ্চিম তাবালেরচর, জেলে পাড়া এবং বড়ঘোপ ইউনিয়নের মুরালিয়া,রোমাই পাড়া এলাকায় গত রাত হতে দ্বীপের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বৈরী আবহাওয়া এবং সৈমুদ্রিক বড় জোয়ারে বেড়িবাধ বিলিন হয়ে কয়েক হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে গেছে। প্রায় ঘরবাড়ী বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। দ্বীপের মানুষগুলো স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে। পানির ধাক্কায় দ্বীপের বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। গত বছর থেকে বেড়িবাঁধের যে অংশ ভাঙ্গা ছিল তা পুনঃনির্মাণ না করায় ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম নুরুল বশর চৌধুরী জানান, রবিবার মধ্যরাত ও সোমবার সকালের বৃষ্টিপাত, উচ্চ জোয়ার এবং বৈরী আবহাওয়ার ফলে ডুবে গিয়েছে কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইলের ১, ২, ৩ ও ৭নং ওয়ার্ড এবং উত্তর ধুরুং এর অধিকাংশ এলাকা। বেড়িবাঁধ ভাঙ্গার ফলে অতীতের মত এবারও ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসেছে অনেক পরিবার। তাদের অধিকাংশই এখন আশ্রয় নিয়েছে সাইক্লোন শেল্টারে।

কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং ইউপির চেয়ারম্যান আ.স.ম শাহরিয়ার চৌধূরী বলেন, বিগত ৪ বছর ধরে উত্তর ধুরুং এলাকার কাইছারপাড়া, চুল্লারপাড়া, চরধুরুং, নয়াকাটা, আকবরবলীপাড়া, ফয়জানির বাপের পাড়া, উত্তর সতর উদ্দিনসহ ১০গ্রাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় পাউবোর প্রায় ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত থাকায় শত শত পরিবার জোয়ারের নোনা জলে ভেসে গেছে।

সেন্টমার্টিন থেকে স্থানীয় ইউনিয়নের সদস্য হাবিব খান জানান, ঝড়ো হাওয়া ও পুর্ণিমার জোয়ারে সৃষ্ট জলোচ্ছাসে সেন্টমার্টিনের মানুষ চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। বাতাসের গতিবেগ এতই প্রবল যে, দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। দ্বীপের ১০/১২ ঘরবাড়ি সাগরে ভেসে গেছে। প্রচুর গাছপালা উপড়ে পড়েছে। ঘর থেকে বাইর হওয়ারও সুযোগ নেই। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে দ্বীপবাসী। প্রচুর পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে।

প্লাবিত এলাকার মানুষের মাঝে উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম নুরুল বশর চৌধুরী্।

সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসাইন জানান, বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে সাগরের লোনাপানি ঢুকে শাহপরীরদ্বীপ ও সাবরাংয়ের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। অনেকে বসতবাড়ি ছেড়ে টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান জানান, মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক পানির চেয়ে ৫/৬ ফুট পানি বেড়েছে। এ কারণে কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জরুরী ভিক্তিতে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, কুতুবদিয়াসহ উপকূলীয় এলাকার খুব খারাপ অবস্থা। আমি জেনেছি। এখনো কোন সাহায্য পাঠানো সম্ভব হয়নি। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

প্লাবিত একটি এলাকার দৃশ্য

কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক সোমবার রাত সাড়ে ১০টায় দৈনিক রূপালী সৈকতকে জানান, উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তরপূর্ব বঙ্গোপসাগর সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে কক্সবাজারে রবিবার রাত থেকে মাঝারি বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র উত্তাল রয়েছে। সোমবার সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে সমুদ্রের পানি ২/৩ ফুট বেড়েছে। অপরদিকে কক্সবাজার শহরের দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিপর্যয়। রবিবার রাত ৮ টা থেকে সোমবার বেলা আড়াইটা পর্যন্ত জেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। আড়াইটার পর কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ এলেও বেশিরভাগ বন্ধ রয়েছে। তার কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এদিকে, সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে কুতুবদিয়া উপকূলের একটি মালবাহী জাহাজ সাগরে আটকা পড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কবলে পড়ে জাহাজটি সাগরের বালিতে আটকে যায়। অবশ্য, সাগর উত্তাল থাকায় এ পর্যন্ত কোনও প্রশাসনিক লোকজন সেখানে যেতে পারেননি। চট্টগ্রাম নৌ-বাহিনীকে খবর দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

সাইক্লোন শেল্টার আশ্রয় নেয়া মানুষ।