বিশেষ প্রতিবেদক:
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশীয় শিল্পকলার সমন্বয় ঘটাতে দেশে অনেক শিল্পী ভূমিকা রেখেছেন। ৫২ ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এদেশের হাতেগোনা কয়েকজন শিল্পী তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন, হাসেম খান, মোস্তফা মনোয়ার, এসএম সুলতান, রনবী’র মতো চিত্র শিল্পীরা তাদের প্রতিভা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন। এসব শিল্পী তাদের তুলিতে এদেশের মাটিকে করেছে বহুগুনে উর্বর। দেশকে করেছে সমৃদ্ধ। গুনি এসব শিল্পীদের অনুসরণ করে মফস্বলেও অনেক শিল্পী তাদের শৈল্পিক শক্তি দিয়ে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন। রং তুলির যাদুতে মানুষকে দেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ধ করেছেন। মফস্বলের এমন একজন প্রতিভাধর চিত্র শিল্পীর নাম ফরিদ আহম্মদ চৌধুরী। যিনি ৩২বছর ধরে রং তুলির যাদুতে নিজেকে একজন পেশাদার চারু ও কারু শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্টিত করেছেন। মনের কল্পনাকে বাস্তবে রুপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তার আকা হাজারো ছবি কেবল ছবিই নয়, এক একটি বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষরও। আমাদের সমাজের নানান অসঙ্গতি তিনি তার তুলির আচলে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আকা তার ছবিগুলো বেশ সমাদৃত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আকা তার ছবিতে স্থান পেয়েছে নারীদের উপর পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের চিত্র। যা মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এছাড়া ভাষা আন্দোলনে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়া সালাম, রফিক, জাব্বার, বরকতের রক্তক্ত ছবি, জাতির পিতার ৭ মার্চের জালাময়ী ভাষনের ছবি মনের মাধুরী মিশিয়ে একেছেন। তার আকা শিশুতোষ, বাল্য বিবাহ, কুসংস্কার, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় কালচার, পর্যটনসহ দেশ মাতৃকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একাধিক জনসচেতনানূলক ছবি সমাদৃত হয়েছে।
জনাব ফরিদ আহম্মদ চৌধুরী জানান, মুক্তিযুদ্ধকে খুব নিকট থেকে দেখেছেন বলেই তিনি পাকবাহিনীর নৃশংসতার চিত্রকে রং এর আচড়ে তুলে ধরতে পেরেছেন। তার আর্কাইভে নিজের আকা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক শতাধিক ছবি রয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দূর্যোগ, প্রকৃতি, সাগর, পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য, রোমান্টিক ও মনিষীদেরও অসংখ্য আকা ছবি তার নিজস্ব ক্যানভাসে জমা রয়েছে।
উখিয়ার ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে ফরিদ আহম্মদ চৌধুরীর জন্ম। তার পিতার নাম মরতুজা আলী চৌধুরী। মরতুজা আলী চৌধুরী খলিলুর রহমান চৌধুরীর বড় সন্তান। খলিলুর রহমান চৌধুরী, উখিয়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক চৌধুরীর পিতা বখতিয়ার আহম্মদ চৌধুরী আপন ভাই।
সমাজ সচেতন ফরিদ আহম্মদ চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু প্রেমী ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পরবর্তীতে হলদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, অবিভক্ত হলদিয়া ৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দীর্ঘদিন হলদিয়া ৯ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি পুরোপুরি সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তিনি শিশু কিশোর সংগঠন অভিলাষ খেলাঘরের দীর্ঘদিন সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এলাকায় একজন সজ্জন ও সাদা মনের মানুষ হিসাবে পরিচিতি। সব বয়সের মানুষকে আপন করে নেওয়ার মতো একটি অসাধারণ গুন তার মধ্যে রয়েছে। ফরিদ আহম্মদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৫ সালের ১৪ জুন। তিনি ৬ ছেলে ও দুই কন্যা সন্তানের জনক।
তিনি অঢেল ধন সম্পদের মালিক না হলেও ছেলেমেয়েদের সৎ ও আদর্শিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তার বড় ছেলে জাবেদ চৌধুরীর কোটবাজার ষ্টেশনে লাইব্রেরী, কম্পিউটার ও স্কীনপিন্টের ব্যবসা রয়েছে। মেঝছেলে রাসেল চৌধুরী একজন প্রতিষ্টিত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা। তার সুনাম ও সুখ্যাতি সার্বজনিন। একজন পরোপকারী ও বন্ধুবৎসল হিসাবে তিনি বেশ জনপ্রিয়। রাসেল চৌধুরী ছোট বোন ফারজানা রুমা। তার বিয়ে হয়েছে হ্নীলার ঐতিহ্যবাহী গফুর মিয়া চৌধুরীর পরিবারে। গফুর মিয়া চৌধুরীর ভাইপো মৌলভী রশিদ আহম্মদের ছেলে মোহম্মদ জাকারিয়ার সাথে। অপর ছেলে মোরশেদ চৌধুরী সৌদি প্রবাসী, মারশেল চৌধুরী একটি এনজিও’র ফিল্ড অফিসার। নওশাদ চৌধুরী উখিয়া কলেজ, এরশাদ চৌধুরী আদর কক্সবাজার সিটি কলেজ, শামীম চৌধুরী কক্সবাজার কেজি এন্ড মডেল স্কুল ও ফাহানা সুমি সদ্য এসএসসি পাশ করেছে। ছেলেমেয়েদের সবাই ভদ্র, নম্র ও চারিত্রিক গুনে গুনান্বিত।
ফরিদ আহম্মদ চৌধুরী দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে চিত্রকর্মের সাথে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছেন। ছোট বেলা থেকেই, এমনকি স্কুলে পড়ার সময়েও তার ছবি আকার প্রতি প্রবল ঝোক ছিল। পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র শিক্ষক সকলকে বিমুগ্ধ করেন বিভিন্ন চিত্রাংকনের মাধ্যমে। ৭৪ সালে এসএসসি পাশের পর ৭৬ সালে চট্টগ্রাম ফিশিং কর্পোরেশনে যোগ দেন। দীর্ঘদিন সুপারভাইজার হিসাবে দায়িত্বপালন করেন তিনি। প্রতিষ্ঠান বেসরকারী করণের বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলনে তার অংকিত বিপ্লবী ও দাবী আদায়ের পোস্টার সকলের নজর কাড়ে। প্রতিবাদী পোস্টারগুলো প্রতিষ্ঠানের চীফ এক্সিকিউটিভ তাহের সোবাহানের নজরে পড়লে তিনি চিত্রশিল্পীকে ডেকে পাটান। উর্ধ্বতন বসের ডাক পড়ায় সবার মনে ভয় ঢুকে যায়, এই বুঝি চাকরি গেল! ভয়ে ভয়ে হাজির হন ফরিদ আহম্মদ চৌধুরী। হাজির হতেই তাকে বুকে জড়িয়ে নেন এবং নিজ ব্যবহৃত গাড়িতে চড়িয়ে চট্টগৃরাম কনফেকশন আর্ট সেন্টারে নিয়ে যান এবং সেখানে ভর্তি করিয়ে দেন। অল্পদিনের মাঝেই দৃষ্টিকাড়া প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। পতেঙ্গা বিমানবন্দরের পাশে বিবর্তন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ম্যাগাজিন ৮৪ এর প্রচ্ছদ করে ব্যাপক সুনাম কুড়ান। পরবর্তীতে তার প্রতিষ্টান বেসরকারীখাতে ছেড়ে দিলে তিনি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন এবং চলে আসেন আপন নীড়ে। ১৯৮৫ সালে কোটবাজারে সর্বপ্রথম উখিয়া উপজেলায় “চৌধুরী আর্ট গ্যালারী” নামে কমার্শিয়াল আর্টের দোকান খোলেন। যুগের পরির্বতনে এই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সাইনবোর্ড, ব্যানার, বিয়ের নকশা, আল্পনা, পোস্টার ইত্যাদি কর্মের জন্য অনন্য প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়। তিনি উখিয়া-টেকনাফের প্রায় ১০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস রুম সজ্জিত করেন। ১৯৯৬ সালে উখিয়া বিজয় মেলায় প্রথম মুক্তিযুদ্ধ বিত্তিক চিত্র প্রদশর্নী করে প্রশংসিত হন।