মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম

সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে-  সরকারী অনেক নেতা ক্ষেত্রবিশেষে মন্ত্রীরাও  জিডিপি এবং মাথাপিছু আয় বাড়া নিয়ে বেশ বাগাড়ম্বর বা স্তুতি করে থাকেন। দেশের জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে দেশ এগুচ্ছে – কিন্তু এতে কি দেশের প্রকৃত সমৃদ্ধি হচ্ছে বা জীবনযাত্রার মানের অগ্রগতি ঘটছে?

মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি হলো গাড়ির স্পিডোমিটারের মতো। অর্থনীতি কতটা দ্রুত বা মন্থর তা বোঝা যায় এটি দেখে। তবে স্পিডোমিটার বলতে পারে না গাড়িটি সঠিক পথে চলছে কি না। পথ বেঠিক বা অসম হলে গতি বৃদ্ধিতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। জিডিপি সামগ্রিক পরিমাণগত হিসাব দেয়। প্রবৃদ্ধিতে জিডিপি বাড়ে, কিন্তু এটি সমৃদ্ধির নির্দেশক নয়। বেশির ভাগ মানুষের জীবনমানের পতন সত্ত্বেও সম্পদশালী কিছু মানুষের আয় বৃদ্ধি কোনো দেশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি এনে দিতে পারে।  বিশ্বের নামকরা অনেক অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিডিপি পদ্ধতিতে কোনো দেশের আর্থিক অগ্রগতি পরিমাপ করা গেলেও এটি ওই দেশের মানুষের সমৃদ্ধি বা সুখের নির্দেশক নয়।

বাংলাদেশ কে নিয়ে সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৮ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশের সরকারি পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে।  ১৪ মে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বার্ষিক ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার। জিডিপি’র মতই বেশ দ্রুত হারে বাড়ছে বাংলাদেশের জাতীয় আয়, সেই সঙ্গে মাথাপিছু আয়।

বিশ্বব্যাংক সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকে। এগুলো হলো: (১) নিম্ন আয়ভুক্ত দেশ (মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত)। (২ক) নিম্ন মধ্যম আয়ভুক্ত দেশ (১ হাজার ২৬ মার্কিন ডলার থেকে ৪ হাজার ৩৫ ডলার)। (২খ) উচ্চ মধ্যম আয় (৪ হাজার ৩৬ মার্কিন ডলার থেকে ১২ হাজার ৪৭৫ ডলার)। (৩) উচ্চ আয়ভুক্ত দেশ (১২ হাজার ৪৭৬ মার্কিন ডলার থেকে বেশি)। সে হিসাবে বাংলাদেশের বার্ষিক গড় মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৫ ডলার অতিক্রম করায়  ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাবের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও ভারত এখনো বাংলাদেশের মতো নিম্ন মধ্যম আয়ভুক্ত দেশ।

বাস্তবতা হচ্ছে- মাথাপিছু আয় বেশি হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন হতে পারে।  আফ্রিকার বহু দেশে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, মধ্যম আয়ের বিবরণে তারা বাংলাদেশ থেকে অনেক আগে থেকেই এগিয়ে, কিন্তু সেখানে মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন। নাইজেরিয়ার মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের চেয়ে ভালো, এটা বলা যাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং আরও খারাপ।

বস্তুত বাংলাদেশের জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পেছনে বড় অবদান হচ্ছে প্রবাসী আয়ের। ২০১৬ সালের পুরো সময়ে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে। রেমিট্যান্সের এই অঙ্ক এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে আসা রেমিট্যান্সের তুলনায় ১৭০ কোটি ১৩ লাখ ডলার বা ১১.১১ শতাংশ কম। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুর কারণে গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ব্যপক হারে। বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটের অনেকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি রেমিট্যান্সের টাকার উপর নির্ভরশীল।

আরো একটি বাস্তবতা হচ্ছে, জিডিপি অগ্রযাত্রা কোনভাবেই চাকরিবাজারের মন্দাবস্থা দূর করতে পারছেনা। যেখানে ২০১০ থেকে ২০১৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৪০ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে ২০১৩ থেকে ২০১৬ অর্থবছর পর্যন্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ১৪ লক্ষ মাত্র। দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রা (জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বিচারে) যেভাবে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ঠিক তার উল্টাহারে হ্রাস পাচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার।

 

গত জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে অনেক অর্থনীতিবিদই বলেন, জিডিপির মধ্যে একটি দেশের মানুষের উন্নয়ন, সন্তুষ্টি বা সমৃদ্ধি পরিমাপের কিছু নেই। এসব বোঝার জন্য ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করার ওপর গুরুত্ব দেন তাঁরা। তাঁদের মতে, জিডিপি দিয়ে একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাপা যায়, কিন্তু দেশের মানুষের ভালো-মন্দের কিছুই বুঝা যায় না। দেশের মানুষের উন্নয়ন বা সমৃদ্ধি পরিমাপের জন্য যুক্ত্ররাজ্য বা ভূটানের উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে।

২০১০ সালে   দেশের মানুষ কতটা ভালো আছে তা জানার জন্য যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন  প্রথমবারের মতো জিডিপির বাইরে পাঁচটি সূচক ব্যবহার করার ঘোষণা দেন। এগুলো হলো ভালো চাকরি, সরকারি নীতির ভালো-মন্দ, পরিবেশ সুরক্ষা, স্বচ্ছতা ও সুস্বাস্থ্য।

তথাকথিত অনুন্নত দেশ হলেও ভুটান মাথাপিছু জাতীয় আয়ে বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে, আইএমএফের বৈশ্বিক রিপোর্টে বাংলাদেশে যখন মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২০০ ডলার অতিক্রম করেছে, তখনই ভুটানে মাথাপিছু আয় তার দ্বিগুণেরও বেশি, আড়াই হাজার ডলার। তারপরও ভুটান জিডিপি–মাথাপিছু আয় নিয়ে সীমাহীন উচ্ছ্বাসে গা ভাসায়নি বরং জিডিপিকেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারণাকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশ্বকে দেওয়া তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনী পদ্ধতি ‘মোট জাতীয় সুখ’ অর্থনীতির পরিমাণগত দিকের ওপর সব ছেড়ে না দিয়ে মানুষের জীবন ও পরিবেশ নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বেশি। এই হিসাব পদ্ধতিতে মোট নয়টি ক্ষেত্র বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়: মানসিক ভালো থাকা, সময়ের ব্যবহার, সম্প্রদায়, জীবনীশক্তি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, বাস্তুতান্ত্রিক স্থিতিস্থাপকতা, জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সুশাসন।

জিডিপি’র সীমাবদ্ধতার জন্য একটি উদাহরণ দিই। ধরা যাক দুটি দেশ এক বছরে ১০০০  টাকার পণ্য ও সেবা উত্পাদন করেছে। অর্থাৎ তাদের জিডিপি সমান। কিন্তু একটি দেশের সরকার ১০০০  টাকার মধ্যে ৭০০  টাকা লুট করেছে। আরেক দেশের সরকার ১০০০  টাকা জনগণের কল্যাণে সমহারে ব্যয় করেছে। এই দুই দেশের মধ্যে কোনটি ভালো, তা জিডিপি বলতে পারে না।

যেখানে ১৬ কোটি মানুষের অধিকাংশের  তিনবেলার খাবার মোটা চালের বাজার মূল্য বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি , সেখানে এ দেশের অধিকাংশ মানুষ জিডিপি’র অগ্রযাত্রার সুবিধা ভালভাবে ভোগ করছে – বলাটা অনুচিত হবে। এ অবস্থায় জিডিপি বা মাথাপিছু আয়  বৃদ্ধি নিয়ে স্তুতিগান গাইতে থাকা সংসদ সদস্যদের ভূমিকাটা আরো বেশি প্রশস্থ হওয়া উচিত। সুনির্বাচনের প্রত্যয় যদি থেকেই থাকে, মানবসূচক সমৃদ্ধির স্তুতিগানই গাইতে হবে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির গান তখন হয়ত কাজে দিবেনা।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে জিডিপির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে ঠিকই কিন্তু তা বিভিন্ন মানব উন্নয়ন সূচক  যেমন শিক্ষার উন্নয়ন, নিরাপদ পানি ও বাসস্থানের সুবিধা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে পারেনা। আর একটি দেশের সমৃদ্ধি বা প্রকৃত উন্নয়ন মানব উন্নয়ন সুচকের উপর নির্ভরশীল, জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির উপর নয়।

 

মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

mmtanim@gmail.com