তাজুল ইসলাম পলাশ, চট্টগ্রাম
পাল্টে গেছে পাহাড় কাটার ধরন। হরেক রকম কায়দায় কাটা হচ্ছে পাহাড়। ওপরের অংশ ন্যাড়া করে রাতের আধাঁরে কাটা হচ্ছে পাহাড়। পাহাড় নিধনযজ্ঞ চাললেও রহস্যেজনক কারনে প্রশাসন ও বনবিভাগ রয়েছে নীরব ভূমিকায়। প্রতিনিয়ত পরিবেশের ওপর এই আগ্রাসন চললেও কারও যেন কোন মাথাব্যথা নেই। এই দৃশ্যে নগরীর ৯ নং উত্তর পাহাড়তলী আকবর শাহ থানার শাপলা আবাসিক এলাকার।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, সরকারি জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে ক্যামিক্যাল ফ্যাক্টরী। দিন দুপরে এই কর্মযজ্ঞ চললে কথিত প্রভাবশালী ব্যক্তির ভয়ে কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। অপরিকল্পিত ভাবে বহুতলভবন ও পক্রিয়াজাত করার জন্য কেমিক্যাল ফ্যাক্টরী নির্মাণ করতে পাহাড় কাটার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ভারি ড্রেজার মেশিন। গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই পাহাড় কাটা। পরিবেশ বিধ্বংসী এই কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে এলাকার চিহ্নত মাটি পাচারকারী চক্র। দীর্ঘদিন থেকে মাটি পাচার করে অবৈধ টাকা আয় করছে এ চক্রটি।

সম্প্রতি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একদিকে পাহাড় কেটে মাটি ভরাট করে ফ্যাক্টরী নির্মাণ অন্যদিকে মাটি পাচার। পাহাড়কাটার ফলে চট্টগ্রামে প্রতিবছর পাহাড় ধসে প্রচুর মানুষ মারা যায়। এ কারনে বর্ষাকালে পাহাড়ী ঢালাতে বসবাসকারী লোকজনদের জীবন হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সবমিলে মারাতœক হুমকির মূখে রয়েছে এলাকার জনগের ভবিষ্যত।

পরিবেশবিদদের মতে, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরী নির্মাণ করলে ভবিষ্যতে শব্দ দোষণ এবং কালো ধোয়াঁয় এলাকার স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের লেখা-পড়ার ক্ষতিসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দেখা দিবে।

স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ওই পাহারের উপরের অংশ যেভাবে কাটা হয়েছে তাতে করে বৃষ্টি হলে এই পাহাড়ের মাটি পানির তোড়ে নিচে দিকে নেমে পড়ে। পাহাড়ের আশেপাশে অন্তত দুই’শ মতো পরিবার রয়েছে। ফলে এই বর্ষায় বড় ধরনের অশংকা থেকেই যায়।

অনুসন্ধানে যানা যায়, যে এই ফ্যাক্টরী নির্মাণ করছে তার নাম এম.এস.আলম । এলাকার সবাই তাকে আলম সাহেব নামেই চেনে। কেমিক্যাল ফ্যাক্টরী ছাড়াও ওই এলাকায় রয়েছে তার মামিয়া ড্রিংকিং ওয়াটার নামে মিনারেল পানির ফ্যাক্টরী। রয়েছে গবাদী পশুর খাদ্য উৎপাদনের কারখানা। এ ছাড়াও নামে বেনামে অনেক কিছুর মালীক তিনি। ফটিকছড়ির সাবেক এম.পি রফিকুল আলমের চাচাতো ভাই বলে পরিচয়দানকারী আলম সাহেব সাবেক মেয়র মনজুর আলমের বেয়াই বলেও জানা গেছে। তার দাপটে বিশাল এই এলাকার জনগোষ্টি এখন কোনঠাঁসা। একের পর এক প্রতিষ্টান নির্মাণ করলেও একটিরও সরকারি অনুমোদন আছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল একটি এলাকা উচুঁ টিন দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছে। বাহির থেকে ভেতরে কি হচ্ছে তা দেখার কোন সুযোগ নেই। আশপাশে গুটি কয়েক দোকান পাট রয়েছে। এলাকার মানুষগুলো কেমন জানি শান্ত সৃষ্ট। কারো মূখে কোনো কথা নেই। মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই কে যেন পেছন থেকে ডাক দিলো। কথা বলে জানতে পারলাম তিনি দায়িত্বরত কেয়ার টেকার। নিজের পরিচয় দিলাম। কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রলোক আসলো। তিনি নিজেকে ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার বলে পরিচয় দেন। কয়েকমাস আগে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন তিনি। আলাপচারিতার এক মুহুর্তে তিনি বেরিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। শুধু কয়েক মিনিট থাকবো বলে অনুমতি নিলাম। অনুরোধ করার পর পুরো এলাকা ঘুরে দেখলাম। জানতে চাইলে দায়িত্বরত ম্যানেজার বলেন, আমি নতুন এসেছি শুধু জানি এখানে ফ্যাক্টরী হচ্ছে। দেখা গেছে, পশ্চিমে পাহাড়, উত্তরে ও দক্ষিণে বসতি এবং সামনে কাচাঁ সড়ক পূর্ব দিকে চলে গেছে। বেশ কয়েকজনকে দেখলাম ভবনের কাজ করতে। জিঙ্গেস করলে দায়িত্বরতরা বলেন, এটা অফিসের কাজ চলতেছে। একটু পশ্চিমে হেঁটে গেলে চোখে পড়ে গবাদির পশুর বিরাট খামার। ওই সময় খামারে কমপক্ষে ৫০টির মতো গরু রয়েছে। পেছনে লক্ষ্যে করলে দেখা যায়, পাহাড়ের বিশাল একটি অংশ কেটে সাবার করা হয়েছে। ওই সময় কয়েকজনকে কাজ করতে দেখা যায়। গবাদি পশুর খামারের পাশে তৈরী করা হচ্ছে বায়ূ গ্যাস। এর পাশেই কেমিক্যাল ফ্যাক্টরী। এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্যে না করে আবারো চলে যাওয়ার অনুরোধ করে দায়িত্বরত ম্যানেজার।

পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্নœ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের যোগসাজশেই এখানে পরিবেশ বিপর্যয়ের মচ্ছব চলছে। শাপলা আবাসিকে পরিদর্শকালে ফুটে ওঠে পরিবেশ বিনষ্টকারী চক্রের অশুভ তৎপরতা। দেখা যায় আলম সাহেবের কেমিক্যাল ফ্যাক্টরী নামক স্থানে শ্রমিক লাগিয়ে বিশাল পাহাড় কেটে সাবার করা হচ্ছে। নিধনের থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে প্রকৃতি। নিজের ক্রয়কৃত ভূমি তাই নিজের ইচ্ছায়ই গাছপালা কেটে নির্বিচারে পাহাড় কাটছেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে খরিদাসূত্রে তাহার কতুটুকু জায়গা তাও নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ২০০৩ সালে কোন এক ব্যক্তি থেকে তিনি ৬ গন্ডা জায়গা ক্রয় করেন। পরবর্তীতে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের নাম ভাঙ্গিয়ে ও সাবেক মেয়র মনজুর আলমের বেয়াই বলে দখল করতে থাকে একের পর সরকারি খাঁস জায়গা। এর আগ্রাসন থেকে রেহাই পাচ্ছেনা চট্টগ্রামের প্রাচীন এই পাহাড়টি। প্রতিদিন রাতের আধাঁরে কাটা হচ্ছে পাহাড়। নিধন করা হচ্ছে ছোট বড় অসংখ্য গাছ পালা।

বৃহস্পতিবার বিকেল (৮ জুন) ৩ টায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে এম.এস,আলম ( মো:সৈয়দ আলম) বলেন, আমার নিজের জায়গার ওপর ফ্যাক্টরী করতেছি। পাহাড় কেটে ফ্যাক্টরী নির্মাণ পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি পরিবেশের ছাড় পত্র নিয়ে কাজ করছি। মামিয়া পাস্তুরিত দুধ, বায়ু গ্যাস ও জৈবসার উৎপাদন কারখানা করছি জনগনের কল্যাণের জন্য। তিনি বলেন, পাহাড় একা আমি কাটছিনা কাউন্সিলর জসিমও কাটে। কথার এক ফাকেঁ তিনি সাবেক মেয়র মনজুর আলমের বেয়াই ও ফটিকছড়ির সাবেক এম.পি রফিকুল আলমের বড় ভাই বলে পরিচয় দেন। আবারও পাহাড় কাটা বিষয়টি নিয়ে কথা বললে আলম বলেন, পাহাড় না কাটলে মানুষ থাকবে কোথায়। তিনি অভিযোগ করেন কাশেম মাস্টারের ছেলেতো কন্ট্রাকে পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করে। তাদের ব্যাপারে লিখতে পারেন না।

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য উত্তর পাহাড়তলী ৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের মোবাইলে একাধিকবার কল করেও তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।

পাহাড় কেটে ফ্যাক্টরী নির্মাণ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড় পত্র আছে কিনা এমন প্রশ্নে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, পাহাড় কাটার জন্য কোন ছাড় পত্র দেওয়া হয়নি। এর পরও কেউ যদি পাহাড় কাটে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আলম সাহেবের বিয়য়টি নজড়ে আনলে মল্লিক বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর আলমকে ৮লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সে পূনরায় পাহাড় কাটে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে কোন প্রকার ছাড় দেওয়া হবেনা।

বাংলাদেশ বন গবেষাণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ বিঙ্ঘানী ছৈয়দুল আলম বলেন, পরিবেশ ধ্বংশের অন্যতম কারণ হচ্ছে পাহাড় কাটা। আমাদের দেশে প্রকৃতি রক্ষায় পাহাড়ের ভূমিকা রয়েছে। গাছ-পালা যেমন প্রতৃতিকে আগলে রাখে পাহাড়ও তার একটি অংশ। তিনি বলেন, পাহাড় কাটার কারনে অতি বৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি হতে পারে। যারা পাহাড় কাটে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর আইন করেছে। কমপক্ষে ১০ বছরের সাজার বিধান রেখেছেন।