নাজনীন সরওয়ার কাবেরী

খরস্রোতা জীবন নদীতে ইতিহাস নামক তরীটাতে তাঁর নাম উঠে আসেনি অথচ জীবন ক্যাম্পাসে তারঁ মুখচ্ছবি প্রতিটি মানুষের বুকে আঁকা হয়ে গেছে।

এমনও মানুষ আছে’ সমাজ বিনির্মাণের জন্য নিজেকে পুড়িয়ে বাতি ঘরে বাতি জ্বালিয়ে অন্ধকারে ফিরেন। নিজের আলোতে জ্বলতে জ্বলতে নিঃশেষ হয়ে সমাজ গড়েন। দেশ মাতৃকার জন্য, নির্মজ্জ্বিত নুয়ে পড়া অন্তরাত্মার জন্য, অসম বিরোধিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে প্রতিরোধে মুখর হতে হতে যুগ যুগান্তরে যাঁরা পৃথিবীকে এগিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের মাঝে অকাল প্রয়াত এক তরুণের নাম আসিফ কামাল চৌধুরী। ১৯৬৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী কক্সবাজার জোয়ারিয়ানালার এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধকালিন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি বিশিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আফসার কামাল চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ¯œাত পারিবারিক আবহে তার জন্ম বলেই খুব ছোট বেলা থেকেই দেশ প্রেম ও মানবতার সেবায় কাজ করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। এলাকার আত্মসামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করেছেন নিজের সাধ্যমত। ছাত্র জীবনে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি বিভিন্ন স্কুল কলেজে ছাত্রদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভুমিকা রাখেন। ১৯৮৩-৮৪ সালে কক্সবাজার কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালিন সময়ে সৈরচার ও জামায়াত-শিবির বিরোধী আেেন্দালনে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হয়ে চট্টগ্রাম নগরীতে ছাত্র সামাজকে ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব দেন। চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত ও চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কক্সবাজার জেলার স¦াংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।

১৯৮৭ সালে মুজিব আর্দশের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার স্বপ্নের মিছিলে এই অসাধারণ তরুণের সাথে আমার ও আমাদের পরিচয়। আমাদের আর্দশের স্বম্মিলন, জীবনবোধের নিগূঢ় চেতনার স্বম্মিলনে, আতœবিশ্বাসী এই ‘তরুন’ আমাকে একটি চিরকুট পাঠালেন, লিখা হল “আমার স্বপ্নের বিপরীতে তোমার কোন বিশ্বাসযোগ্য আবাসভূমি থাকতে পারে না, সমৃদ্ধির

বহমান গতিময়তায় তুমি কখনোই পেতে পারো না কাঙ্কিত সুখের মোহনা, আমি স্বপ্নকে সঞ্চিত করেছি বছরের পর বছর ধরে, মানবিক অগ্রযাত্রার ঐতিহাসিক বিজয় হতে তুষের আগুনে পুড়ে কষ্টের নদী পেরিয়েছি বলেই’ আমার স্বপ্নেরা পেয়েছে একান্ত ভালবাসার অধিকার, আমার ভালবাসার নিগড়ে এসো মহিমান্বিত হবে’ স্কাড ক্ষেপনাস্ত্র ও পারমানবিক ভয়াবহতার বিপরীতে পাবে এক নিবিড় আশ্রয়, আমার ভালবাসার নিগড়ে এসো মহিমান্বিত হবে”। উত্তরে লিখেছিলাম, “তোমার উদ্দাম মিছিলে বহ্নি হব আর দূর্বার প্রেরণায় শিখা ছড়াবো” রাজপথে সংসার বাঁধবার শপথ নিয়ে ছিলাম। ব্যাতিক্রম বিন্দু মাত্রই হয়নি, সে শপথ থেকেই এখনো মিছিলেই আমার সংসার, আমার কষ্ঠ ও আমার ভাল থাকা। প্রতিবাদ প্রতিরোধের মিছিলে এখনো তাঁকে খুঁজে ফিরি, আমি কিংবা আমরা। কখনো শুণ্যে তাঁর দৃঢ় হাত ধরে শপথ গড়ি, কখনো স্মিত হেসে বলি” বন্ধু তুমি ঘুমাও” আমি ও আমরা আজ অতন্দ্র প্রহরী। মানুষের অধিকার মানুষের কান্নায় দুস্তর দুরন্ত।

স্বৈরাচার সরকার ও রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চরিত্রের কারণে এই তরুণের হাতে পায়ে ছিল পুলিশি হামলা ও মামলা নির্যাতন। কদিন পর পরই মিথ্যা মামলায় জেলে অন্তরীণ করা হত, উপর্যুপরী হুলিয়া, শত্রু পক্ষের রোষানল, বাউন্ডলী জীবনে পরিবারের অনেকেই আমার জীবন নিয়ে সংকিত হয়ে পড়েছিলেন। দূর্বার মিছিলে কথা দিয়ে ছিলাম শত প্রতিকুলতার মধ্যেও আর্দশের পাশে আর্দশেরই পতাকা উড়াব। নিজ দায়িত্বে সংসার বেঁধে ছিলাম ১৯৯৩ সালের ২রা আগস্ট। সংসার জীবনে প্রতিদিন নতুন আরেক মানুষকে আবিস্কার করেছি। কখনো মায়ের সব চেয়ে প্রিয় সন্তান, কখনো প্রিয় ভাই, কখনো দুর্দিনের পরম বন্ধু, আবার কখনো বা সমাজের সব চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তি। প্রতিদিন নতুনভাবে শ্রদ্ধাশীল হয়েছিলাম। অবাক হয়েছিলাম আমার লালিত স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে।

১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ তারিখে আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছিল। আসিফ সন্তানের নাম রাখলেন ‘স্বাধীন’। ১৯৯৮ সালে জন্ম হল ১ম কন্যসন্তান, নাম রাখা হল ‘তুজান’। ২০০১ সালে ২য় কন্যা ‘সুজান’। সন্তানের পিতারুপে আরেক দায়িত্ববান বাবাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। তিনি প্রায় বলতেন আমার হাসিটুকুর জন্য তার যত এগিয়ে চলা। আমি এভাবে সম্মানিত হয়েছি প্রতিনিয়ত। উদার হস্তে দান, নামাজ কায়েম ও রোজা পালনে তাঁকে সব সময় ব্রত দেখেছি। তাঁর অসাধারণ সৎ সাহসীকতা, অনন্য মেধা, পরিশ্রমী জীবন, নির্লোভ মানষিকতা, সংযমপুর্ণ জীবন ও মহান আল্লাহর হুকুমের প্রতি অনন্য সর্মপণে অনেকেই বলতেন, ” তিনি সৃষ্টিকর্তার বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে প্রেরিত মানুষের ছন্মবেশী মানুষরুপে আর্বিভুত” তাঁর অকাল প্রয়াণে আমরা যাঁরা কাছের মানুষ আমরা তাই বুঝেছি। ২০০৬ সালের ১০ই জুন তারিখে রোজ শনিবার চট্টগ্রামস্থ নিজবাসভূমে খুব স¦াবাভিক ভাবে মৃত্যুবরণ করেন । উল্লেখ্য যে, তার একদিন আগেই কক্সবাজার ০৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচনের র্প্রাথী হিসেবে তিনি প্রাথমিক মনোনয়ন লাভ করেছিলেন । অনাকাংখিত ওয়ান ইলেভেনের কারণবশত সেই নির্বাচন টি স্থগিত ছিল।

আমরা সহযোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচন, আঞ্চলিক নির্বাচন ও দেশের র্দুযোগময় মুর্হূতে সাধারন র্কমী হিসেবে কাজ করেছি । তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি, বিশাল স্বপ্নভান্ডারের সঙ্গী হিসেবে আমাকে দিয়েছিলেন এক ঝুড়িঁ স্বপ্ন । উৎসের পানে হাঁটতে হাঁটতে আমিও তার স্বপ্নের লক্ষ্যেই পৌছাঁতে চাই। আসিফের অকাল প্রয়ান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার জন্য উপঢৌকনও বটে। তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমি জেনেছি পৃথিবীটা একটা পরীক্ষা কেন্দ্র মাত্র। এই সীমিত সময়ের প্রতি লোভাতুর না হয়ে অনন্ত জীবনের প্রত্যাশাই মুখ্য। তাঁর বিদায় কষ্ঠে পৃথিবীর সব দুঃখকে জয় করার শক্তি সামর্থ্য আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। মুলত আল্লাহ মানুষের জন্য যা কিছু মঙ্গল’ তাই করেন।

আজকের কিছু বিভ্রান্ত তরুণ যারা মুজিব আর্দশের সহ¯্র মাইল দুরে থেকেই তাঁর আর্দশের ভনিতা করছেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলব জীবনটা খুবই ছোট, ছোট জীবনটাকে সততা ও সেবার মাধ্যমে চাইলে অমর করা সম্ভব।

আমাদের পূর্বগামী আলোকিত মানুষগুলোর জীবন পর্যালোচনা করে বিন্দু মাত্র হলেও মহানুভব হয়ে মানুষের বন্ধু হই। অগ্রগামীরা যে বীজ বপন করে গেছেন উপড়ানো’ নয় কিছুটা জল কিছুটা ভালবাসা দিয়ে অঙ্কুরোদগমে ছাঁয়া ছড়িয়ে দিই, সমাজের জাতির ও দেশের। মহান রাব্বুল আলামিনের প্রতি এই ক্ষণ জন্মা মানুষের সহধর্মিনী হওয়ার সৌভাগ্য দান করার জন্য কৃতজ্ঞতা অপার।।

চলার পথে অজ¯্র শুভাকাঙ্খিগণ আমাদের চলার পথে সহযোগিতা সহর্মমীতার মাধ্যমে অনুপ্রেরিত করেছেন তাদের প্রতি আমাদের বিন¤্র শ্রদ্ধা।

লেখক- নাজনীন সরওয়ার কাবেরী, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, কক্সবাজার জেলা-।