প্রথম আলো:
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন টানা দুই মেয়াদের সরকারের আটটি বাজেট যথাসম্ভব ভালোয় ভালোয়ই দিয়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এবারই বড় চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি। চ্যালেঞ্জটি মূলত নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আইন কার্যকর করা নিয়ে।

এ এম এ মুহিত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম কম ছিল, যার সুফলও পেয়েছে সাধারণ মানুষ। দেশেও খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ছিল ভালো। ২০১৪ সালে আবার যখন অর্থমন্ত্রী হন, আন্তর্জাতিক বাজারে তারপরই কমতে থাকে জ্বালানি তেলের দাম। এসব ইতিবাচক দিক ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

কিন্তু এবার বাজেট দেওয়ার সময়ে এসে সেই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় খুব একটা নেই অর্থমন্ত্রী। প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) কমে যাচ্ছে, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি শ্লথ, চালের দামও বাড়তি। আবার রাজস্ব সংগ্রহে ১৫ শতাংশ একক ভ্যাট হার আরোপ করলেও তাতে খুশি নন একশ্রেণির ব্যবসায়ী। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে, বৃদ্ধি পাবে মূল্যস্ফীতি। অর্থমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ এখানেও।

অন্যদিক থেকে আগামী বাজেটটি নির্বাচনী বাজেটও। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, ‘এটাই আমার শেষ কার্যকরী বাজেট।’ কারণ, পরেরবারের (২০১৮-১৯ অর্থবছর) বাজেট ঘোষণার কয়েক মাস পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা।

টানাপোড়েনের এমন বাস্তবতা সামনে রেখেই আজ বৃহস্পতিবার ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। আট বছরের বাজেটে ধারাবাহিকভাবে আকার বৃদ্ধি ছাড়া বড় ধরনের কোনো নীতি সংস্কার করেননি অর্থমন্ত্রী। পুরো সময়ে অর্থমন্ত্রীর একমাত্র ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হচ্ছে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর। তবে এই চ্যালেঞ্জটি তিনি গতবারই নিতে চেয়েছিলেন, ব্যবসায়ীদের বিরোধিতায় পরে পিছিয়ে আসেন।

নতুন বাজেটটি হবে বর্তমান সরকারের মেয়াদের পূর্ণ অর্থবছরের শেষ বাজেট। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু নির্বাচন সামনে, তাই কিছুটা লোকরঞ্জনের বিষয় থাকবে। রাজনৈতিক বিবেচনা এবং জনস্বার্থের সমন্বয় হলে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু বাজেটটি অন্য একটি কারণেও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারত। বিগত বছরগুলোতে সরকারের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে অর্জন, তাকে সুসংহত করার একটি সুযোগ ছিল। বিশেষ করে অর্থনীতির রূপান্তরগত পরিবর্তনে কিছু সংস্কারের সূচনা করা দরকার ছিল। এগুলো হলো আর্থিক খাতের শৃঙ্খলার অবনতি; বিনিয়োগের পরিবেশের আস্থার অভাব ও বিদেশে পুঁজিবাজার এবং সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে গতিশীলতা ও অপচয় রোধ। এসব ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নেওয়া হলে ভালো হতো।

অর্থমন্ত্রীর ব্যক্তিগত একাদশ বাজেট এটি। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের দুই দফায় তাঁর এটি টানা নবম বাজেট। এ এম এ মুহিত এর আগে ১৯৮২-৮৩ এবং ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরেও দুবার বাজেট পেশ করেছিলেন। অর্থমন্ত্রী এবার ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের’ নাম দিয়ে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট দিচ্ছেন, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা থেকে ২৬ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা থেকে আগামী বাজেটের আকার বেশি প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ধরা হচ্ছে ২২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। আর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার রাখা হচ্ছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর সম্ভাব্য মূল্যস্ফীতির হার ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

যোগাযোগ করলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী বাজেটটি নির্বাচনী বাজেট বলেই তা বিরাট করে করা হচ্ছে। আমার আশঙ্কা, এ বাজেটের রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়—কোনোটিরই সক্ষমতা সরকারের নেই।’

বাজেটে রাজস্ব বা অনুন্নয়ন এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বা উন্নয়ন অংশ আলাদা করে দেখানো হয়। নতুন বাজেটে অনুন্নয়ন বাজেটের আকার দাঁড়াতে পারে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৬৬ কোটি টাকা, আর এডিপি থাকছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য থাকতে পারে ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে একা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেই (এনবিআর) সংগ্রহ করতে হবে ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা।

আগামী বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ থাকছে স্মরণকালের সর্বোচ্চ, যা পরিমাণের দিক থেকে যেমন বেশি, হারের দিক থেকেও। এবার বাজেট ঘাটতি থাকছে জিডিপির ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, পরিমাণে যা প্রথমবারের মতো ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে।

প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে ভ্যাট চালু করার পর থেকে এটিই হচ্ছে রাজস্ব সংগ্রহের প্রধান উৎস। দ্বিতীয় উৎস আয়কর। মূসক চালুর জন্য সাইফুর রহমানকে সব সময়ই ধন্যবাদ দিয়ে থাকেন মুহিত।

রাজস্ব সংগ্রহে আগামী অর্থবছরেও মূসকই হচ্ছে সর্বোচ্চ উৎস। অর্থাৎ এনবিআরকে আয়ের যে লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে ভ্যাটের অংশই ৮৭ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা থাকবে। এ ছাড়া ৮৬ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা আয়কর এবং ৭৩ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা শুল্ক আদায় করতে হবে এনবিআরকে।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার দেশ-বিদেশ থেকে ঋণ নেয়, যার মধ্যে বেশি ঋণ নিয়ে থাকে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই। ব্যাংক থেকে স্বল্প, দীর্ঘ—দুধরনের ঋণ নিলেও বেশি নেয় দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। ঘাটতি মেটাতে এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেও ভালো একটা টাকা সংগ্রহ করে সরকার।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সংগ্রহ করা হবে ২২ হাজার কোটি টাকা। মির্জ্জা আজিজ অবশ্য বলেন, ‘ঘাটতি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, পুরো বাজেটের বাস্তবায়নই তো হবে না।’

উন্নয়ন ব্যয় বাদ দিলে অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে আগামী বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ঋণের সুদ পরিশোধ এবং ভর্তুকিতেই ব্যয় হয়ে যাবে এক-তৃতীয়াংশ। এর পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি হবে বলে জানা গেছে।

চিন্তায় আছেন আমানতকারীরাও। ব্যাংকে টাকা জমালে লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি হয় কি না, সেই দুশ্চিন্তায় আছেন তাঁরা। কারণ, একদিকে আমানতের সুদ কম, তার ওপর আমানতের টাকার ওপর আবগারি শুল্ক দ্বিগুণ প্রস্তাব করা হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের মতো আগামী বাজেটেও ফার্স্ট ট্র্যাক বা বড় প্রকল্পের জন্য বিশেষ বাজেট অর্থাৎ ৩৩ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা। এ আওতায় বিভিন্ন ভাতার পরিমাণ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বছরে দুটি উৎসব ভাতার প্রস্তাব আছে।

নতুন ভ্যাট আইনে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে বেশ কিছু পণ্যে ভ্যাট ছাড় দেওয়া হতে পারে। এই তালিকায় থাকছে মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর ও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) সংযোজন শিল্প, ভোজ্যতেল, সফটওয়্যার শিল্প, বাস-ট্রেন-লঞ্চের টিকিট ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রায় ১৪ শ পণ্য ও সেবায় বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখা হচ্ছে। কিছু পণ্য ও সেবায় সম্পূরক শুল্ক হার বাড়ানো হতে পারে।

আয়কর খাতে কিছু পরিবর্তন আসছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা বাড়িয়ে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হতে পারে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের বর্তমান উৎসে কর দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হতে পারে।