ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জোরালো সমর্থন থাকলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার করা হচ্ছে না ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। বিশ্লেষকদের মতে, ইভিএম প্রযুক্তি থেকে বছর পাঁচেক আগে সরে আসা বর্তমান ইসি নতুন করে এটি ব্যবহারে প্রস্তুত নয়। তাই তাড়াহুড়া করে এ যন্ত্রের ব্যবহার করা ঠিকও হবে না। এর সঙ্গে স্টেক-হোল্ডারদের পরিচিত করানোসহ আস্থা অর্জনের পরই এর ব্যবহার করতে হবে। নয় বিতর্ক বাড়বে।এছাড়া এই ইস্যুতে বিএনপির আনুষ্ঠানিক আপত্তি ও কারিগরি দীর্ঘসূত্রিতার আশঙ্কা তো রয়েছেই। ফলে আগামী নির্বাচনে ই-ভোটিংয়ের সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসির চালু করা ইভিএমে প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে যন্ত্রটিকে অনেকটা ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে ই-ভোটিংয়ের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিরাজমান সব বিধিবিধানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জনমানুষের ভোটাধিকার অধিকতর সুনিশ্চিত করার স্বার্থে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ই-ভোটিংয়ের প্রবর্তন করার পরিকল্পনা বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।’ অবশ্য এর আগে নতুন ইসি গঠন নিয়ে গত ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপেও আওয়ামী লীগ আগামী ই-ভোটিং চালুর প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নড়েচড়ে বসে।

বিএনপি ইতোমধ্যে ইভিএম ব্যবহারে আপত্তি জানিয়ে ইসিতে চিঠি দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, ডিজিটাল ভোটের নামে মেশিন টেম্পারিং করে আওয়ামী লীগ জনগণের ভোট নিজেদের বাক্সে নিতে চায়। সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব স্বাক্ষরিত চিঠি সিইসিকে দেওয়ার পর দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন,‘আগামী সংসদ নির্বাচনে যেন ইভিএম ব্যবহার করা না হয়, সে জন্য সিইসিকে বলা হয়েছে। ইভিএমের মাধ্যমে ডিজিটাল কারচুপির শঙ্কা রয়েছে।’

ক্ষমতাসীনদের অভিযোগ,বিএনপি ভোট কারচুপিতে বিশ্বাস করে বলেই ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ইসি যদি আমাদের ডাকে, আমরা ইভিএমের পক্ষে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরব। তবে এর ব্যবহার হবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।’

ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে চাইলে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ব্যাপক আকারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ভোটারদেরও করতে হবে সচেতন। এছাড়া ভোটগ্রহণে প্রতিটি ভোটকক্ষে অন্তত একটি ব্যালট ইউনিট ও একটি কন্ট্রোল ইউনিট। যান্ত্রিক গোলযোগ এড়াতে প্রতি কেন্দ্রে রাখতে হবে বাড়তি ইভিএম। এর সঙ্গে রাখতে হবে বৈদ্যুতিক ব্যাকআপ।’

ইসির একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘ইভিএম ডিভাইস কিনতে গেলে  জটিলতা যে পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?’ চাইলেই কেউ ৩ লাখ ডিভাইস সরবরাহ করতে পারবে না। কোনও প্রতিষ্ঠানকে অর্ডার দিলে এটা তৈরি করে দিতে তো খানিকটা সময় লাগবে।’

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানা গেছে, ইভিএম ব্যবহারে কোনও দায়দায়িত্ব ইসি নিতে চায় না। তাই তাদের রোডম্যাপে এই বিষয়টি রাখাই হয়নি। বিষয়টির সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ইসি রাজনৈতিক দলের ওপর ছেড়ে দিয়েছে বলে কমিশনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা আগেই জানিয়েছেন রাজনৈতিক দল আস্থা না আনলে তারা ইভিএম-এ এতে যাবেন না।

ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল যুগে আমাদের প্রবেশ করতে হবে। নির্বাচন নিয়ে আমাদের দেশে যে পর্যায় বিতর্ক চলছে, তাতে ইভিএম সম্ভব বলে আমি মনে করি না। কমিশন কারিগরিভাবে এর প্রস্তুতি নিতে পারলেও সব দলকে একই প্লাটফর্মে আনতে পারবে বলে মনে হয় না। ’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘কমিশন কিসের ভিত্তিতে বললেন রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে ইভিএম ব্যবহার সম্ভব। তাদের প্ল্যান সম্পর্কে জানি না। সে জন্য এ বিষয়ে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আর আসলে কিসের ভিত্তিতে কমিশন ইভিএম ব্যবহার করতে চায়,তা বোধগম্য নয়। ১৮ মাসে তিন লাখ মেশিন কিভাবে প্রস্তুত করবে?’

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশন এটিএম শামসুল হুদা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কারিগরিভাবে ইভিএম সম্ভব হলেও রাজনৈতিকভাবে সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক দল না চাইলে এসব নিয়ে ইসির ঝামেলায় যাওয়া ‍ঠিক হবে না।’

নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আবদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। রাজনৈতিক দল চাইলে ইভিএম, নইলে নয়। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে আমাদের এজেন্ডায় ইভিএম থাকবে। আমরা সব দলের সমর্থন পাব কিনা, সেটা আগে দেখতে হবে। সবাই সমর্থন দিলেই এটা নিয়ে এগুনো যাবে।’

সবাই চাইলেও বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দীর্ঘসূত্রিতার ঘটনা ঘটতে পারে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘এখানে অনেক ফ্যাক্টর জড়িত। ইভিএম ডিভাইস সংগ্রহ বা অন্য কিছু কাজে দীর্ঘসূত্রিতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে, আমার ধারণা বিশ্বে,এমন দেশ বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের একমাস সময় দিলে তারা এগুলো তৈরি করে দিতে পারবে। এখানে যারা টেন্ডারে অংশগ্রহণ করবে, ওই চ্যালেঞ্জ নিয়েই করবে।’