এইচ.এম নজরুল ইসলাম

সাংবাদিকতার জগতটি গত এক যুগে অনেক প্রসারিত হয়েছে। সংবাদপত্রের পাশাপাশি নতুন নতুন মিডিয়া বিশেষ করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, এফএম রেডিও এবং সর্বশেষ ইন্টারনেটভিত্তিক পত্রিকা বাংলাদেশে এই পেশার অনেক সম্ভাবনা তৈরি করেছে । কক্সবাজার জেলার মতো ছোট একটি শহরে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা প্রায় ২০/২১টি যার অধিকাংশই বর্তমান সরকারের সময়ে অনুমোদন লাভ করে, বলতে গেলে বর্তমান সরকার গণমাধ্যম সরকার। গণমাধ্যম প্রসারের সাথে সাথে আজকাল শিশু-কিশোরদের অনেকেই ভবিষ্যতে সাংবাদিক হতে চায় এমন আকাঙ্খার কথা অল্প বয়সেই প্রকাশ করে। যেমনটি আমি হাই স্কুলে পড়া অবস্থায় লেখালেখিতে যুক্ত হই; সাংবাদিকতা নামক মহান পেশায় জড়িয়ে যাই ইউনিসেফ পরিচালিত শিশু প্রকাশ সংবাদ সংস্থা(এমএমসি)র মাধ্যমে ২০০৫ সালের শুরুতে। সে থেকে আজ পর্যন্ত উৎপ্রোতভাবে সংবাদ জগতের সাথে জড়িয়ে আছি। তবে এখনো পেশা হিসেবে গ্রহণ করিনি। কিন্তু প্রতি মূহুর্তে আমার একমাত্র নেশার জায়গাটি দখল করে রেখেছে সংবাদপত্র নামক ক্ষেত্রটি।

এক যুগের কাছাকাছি সময়ে জড়িয়ে থাকা একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে বলতে পারি দিন দিন যে হারে সংবাদপত্রের প্রসার গড়ছে ঠিক সেই হারে সরে যাচ্ছে দক্ষ গণমাধ্যম কর্মীরা। বলতে গেলে মেধাবীরা এখন সাংবাদিকতায় আসছেন কম। পেশাদার, স্বাধীন মিডিয়ার অভাব এখনো প্রকট। নিজের অন্যায় ব্যবসাকে সুরক্ষা দিতে এবং সমাজে আরো প্রভাব- প্রতিপত্তি অর্জন করতে অধিকাংশ উদ্যোক্তা মিডিয়া মালিক হচ্ছেন। একটু পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে পর্যটন শহরে নিয়মিত-অনিয়মিত প্রায় ২০/২১ টি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে তাদের মধ্যে কতজন পত্রিকার মালিক সাংবাদিকতার মতো মহান পেশায় জড়িত ছিলেন? কতজন পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশক অর্থবিত্তের মালিক? কোন লক্ষ উদ্দ্যেশে নিয়ে তারা স্থানীয় পত্রিকা প্রকাশের মতো লোকসানী ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন? আমরা যারা ‘সংবাদপত্রের শ্রমিক’ বা সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি আমরা কি কখনো জানতে চেয়েছি পত্রিকার মালিক পক্ষ কার স্বার্থে মিডিয়া জগতে নাম লিখিয়েছে? শুধু চেয়েছি ভালো বেতনের চাকরি! একটু চিন্তা করলে দেখা যায়

মূলত এই উদ্যোক্তারা স্বাধীন গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় বিপদ। তারা প্রতি পদে পদে স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতায় হস্থক্ষেপ করেন। আর রাজনৈতিক মতাদর্শে ও নগদ পাওনার লোভে বিভক্ত সাংবাদিকরা সহজেই এইসব উদ্যোক্তার শিকারে পরিণত হচ্ছেন। দলীয় সরকারের বিলিয়ে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা নিলে একজন সাংবাদিককে বারবার আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হয়। গণমাধ্যমের অসৎ উদ্যোক্তার অবৈধ কাজের হাতিয়ার হতে অবাধ্য ক’জন সাংবাদিক এ পর্যন্ত চাকরি ছেড়েছেন? হিসাব মেলানো কঠিন।

তারপরও পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য এখনকার কোনো কোনো সাংবাদিকের আকাঙ্খা আশান্বিত করে। লোভের কাছে নতজানু না হওয়া, অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করা, পেশার প্রতি সৎ থাকা আর নিজের যোগ্যতা ধারাবাহিকভাবে বাড়িয়ে চলাটাই পেশাদারিত্ব অর্জনের মূলকথা। সাংবাদিকতা পেশায় এতোসব নোংরা জঞ্জালের মধ্যে এখনো অনেকে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন। সেইসব সাংবাদিকের জন্য শুভকামনা

এটিও সত্য সাংবাদিকতা পেশার সম্মান, মর্যাদা বেড়েছে আগের চাইতে বহুগুন। সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রয়োজনীয় পেশাদারিত্ব কি বেড়েছে ব্যক্তি সাংবাদিকের? বেড়েছে কি সাংবাদিকদের স্বাধীনতা? কমরর্ত সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিকদের থেকে শুরু করে সাংবাদিক সংগঠন গুলো আলোচনায় এখন বেশ হা-হুতাশ শুনতে পাওয়া যায় যদিও বা সেটি সভা সেমিনারে সিমাবদ্ধ।

যে কোনো পেশার জন্যই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আমলা বা অন্য যে কোনো পেশার কেউ যথেষ্ট দক্ষ-যোগ্য, সৎ ও দলনিরপেক্ষ না হলে সাংবাদিকরা তাদের নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু সাংবাদিকদের কতজন ওইসব গুনের অধিকারী? বিশেষ করে এখনকার সময়ে যারা দাপড়িয়ে ভেড়াচ্ছেন রতিমহারতি সাংবাদিকরা। যখন অন্য সব পেশার মতো সাংবাদিকতাতেও অযোগ্য, অদক্ষ, অসৎ এবং দলবাজদের জয়-জয়াকার দেখা যায়।

পেশাদারিত্বের বিষয়টি পেশার প্রতি সৎ ও আন্তরিক থাকা এবং যোগ্যতা ও দক্ষতার একটা মান অর্জনের সঙ্গে জড়িত। আজকের সাংবাদিকতার জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জও এটাই। সাংবাদিকতা পেশায় সম্মান, সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি ইলেকট্রনিক মাধ্যমের কল্যাণে এখন একজন সাংবাদিক দ্রুই দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে পরিচিতি পেয়ে যাচ্ছেন। তারকার মর্যাদা পাচ্ছেন। নবীন অনেককে পেশার এই আকৃষ্ট করছে।

একজন ভালো ও পেশাদার সাংবাদিক হওয়ার জন্য কি কি প্রয়োজন? আজকের প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানিত সাংবাদিকদের অনেকেই বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করে এসেছেন। ভালো সাংবাদিক হওয়ার জন্য সাংবাদিকতাই পড়তে হবে এমনটা জরুরি নয় এটি আমি চ্যালেন্স করে বলতে পারি। তবে বিষয়টি পড়া থাকলে একজনকে ভালো সাংবাদিক হতে তা অবশ্যই সাহায্য করে। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমগুলো এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের পেশায় নিয়োগ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমি সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশুনা না করলেও অন্তত অর্ধশতাধিক সাংবাদিক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অর্শগ্রহণ এর মাধ্যেমে বুঝেছি সাংবাদিকদের ‘সব কাজের কাজী’ হতে হয়।

অর্থাৎ অনেক বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান থাকা একজন সাংবাদিকের জন্য জরুরি। সেটা খেলা, অর্থনীতি ও বাণিজ্য, আইন-আদালত, সংবিধান, জ্বালানির মতো বিষয় হতে পারে। দেখা যায়, বার্তা কক্ষে যারা প্রথম কাজ শুরু করেন- তাদের বেশির ভাগ এমনকি খ্যাতিমান ব্যক্তির নামের বানান পর্যন্ত জানেন না। দলে রাজনীতিবিদদের পদ-পদবী সম্পর্কেও অবহিত নন। এইরকম মৌলিক এবং প্রতিদিনের কাজের জন্য জরুরি বিষয় নিয়েও তাদের বার্তা কক্ষে ঢুকে হিমশিম খেতে হয়! বিষয়গুলো কি পড়াশুনার সময়ই সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের শেখানোর ব্যবস্থা করা যায় না?

আমার অভিজ্ঞতা থেকে যেটি দেখলাম সাংবাদিকদের মধ্যে সবসময়ই দুটো ধরণ দেখা যায়। একদল একে চাকরি হিসাবে নেন। নির্দিষ্ট সময়ের বেশি পেশায় দেন না। ছকবাধা কাজে অভ্যস্ত এবং এতেই তারা স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। এই শ্রেনীর সাংবাদিকরা পেশায় শেষ পর্যন্ত ভালো করতে পারেন না। আরেক দল আছেন, যারা পেশাকে নেশা হিসেবে নেন। বহুমুখী কাজ করতে আগ্রহী। সময় ধরে নয়, কাজের প্রয়োজনে যতোটা দরকার পেশায় ততোটাই সময় দেন। এই ধরণের সাংবাদিকদের নিয়ে কাজ করতে যে কোনো পেশাদার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানও আগ্রহী হয়। পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য একজন সাংবাদিকের দেশ-বিদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখাটা জরুরি। নিয়মিত দেশ-বিদেশের সংবাদপত্র পড়া, টেলিভিশনের নিউজ চ্যানেলগুলো অনুসরণ করা, ইন্টারনেটে খবর ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে নজর রাখা ভালো সাংবাদিক হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।

জাতীয় সংবাদ মাধ্যম গুলোতে যতটুকু জানি, নিজের নির্দিষ্ট বিটের বাইরে অন্য বিষয় নিয়ে পড়াশুনা তো দূরের কথা, খোঁজ-খবরও রাখেন না। রাজনৈতিক প্রতিবেদক অর্থনীতির ব্যাপারে আগ্রহ দেখান না। অর্থনৈতিক প্রতিবেদক রাজনীতির অগ্রগতি সম্পর্কে জানেন না। আদালত রিপোর্টিং অনেকের কাছে আতঙ্কের বিষয় মনে হয়। আধা-নিশ্চিত তথ্য প্রকাশের লোভ অনেকেই সামলাতে পারেন না। অথচ সর্বক্ষেত্রে ভূলত্রুটির মাঝেও সব বিষয়ে সংবাদ তৈরির অভিজ্ঞতার পরিচয় দিতে হয় মফস্বলে যারা কাজ করেন সেইসব সংবাদকর্মীদের। তারপরও জাতীয় পর্যয়ে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না।

পরিশেষে বলব একজন সাংবাদিককে পাঠক বা দর্শক শ্রোতার আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে হয়। এ কারণে তাকে কষ্ট করতে হয়, পেশায় দক্ষতা দেখাতে হয়। আজ বাংলাদেশে যে “মিডিয়া বুম” চলছে, সেখানে আমরা এইরকম পেশাদার সাংবাদিক খুঁজে পাই না। সাংবাদিকতা পেশায় এখন যারা আসছেন তাদের বড় অংশই দ্রুত সাফল্য আর তারকাখ্যাতি চান।

নিজের অভিজ্ঞতায় দেখছি, সাংবাদিকতা শুরু করার মাত্র দুই বা আড়াই বছরের মধ্যে তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান বদলে একজন সাংবাদিক সহজেই ১৫ বা ২০ হাজার টাকা বেতন-ভাতা পেয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই আবার নিজের অস্থিত্ব ঠিকে রাখতে বা নিজের প্রয়োজনে নবাগত সংবাদকর্মীকে ব্যবহার করতে এমন কিছু সিনিয়র সংবাদিক আছেন যা নিজেই একাধিক সংবাদপত্র দখল করে রেখেছেন।

একটু চিন্তাশক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়, যাদের লিখনিতে কতৃত্ববাদ,দলীয় করন মুক্ত হয় সমাজের রাগববোয়াদের রাজত্ব। আজ সেই লেখক সাংবাদিকরাই নিজের স্বার্থে কতৃত্ব সৃষ্ঠি করে রেখেছে মিডিয়া জগতে। আর এই সহজ ফলটি ভোগ করছে লুঠেরা শ্রেণীর পত্রিকার মালিক পক্ষ।

“মিডিয়া বুমে”র বিপরীতে সাংবাদিকের স্বল্পতায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটা ছোটো অর্থনীতিতে এত সংবাদপত্র/টেলিভিশন কয়েকটি ওয়েব সংবাদপত্র অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হবে কিনা, দীর্ঘমেয়াদে এসব গণমাধ্যম সাংবাদিক-কর্মীদের সম্মানজনক হারে বেতন-ভাতা দিয়ে যেতে পারবে কিনা, সে বিবেচনাটা কারো মধ্যেই থাকে না। আপাতত নগদ পাওনাটা তাদের কাছে মূখ্য হয়ে ওঠে। জাতীয় পর্যয়ের সংবাদমাধ্যম গুলোর কথা নাই বা বললাম জেলা থেকে প্রকাশিত ২০/২১টি পত্রিকার মধ্যে কয়টি পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিকের বেতন দেন।

কেনই বা টাকা দিয়ে সংবাদ পত্রের পরিচয়পত্র কিনে নিয়ে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশায় জড়িয়ে পড়েছে? আর যারা পরিচয় পত্র টাকার বিনিময়ে কিনে নিয়ে সাংবাদিক পরিচয়ে চষে ভেড়াচ্ছে তাদের লক্ষ উদ্দ্যেশ্য কি?

সর্বপরি বলব গণমাধ্যমের চাই সুষ্ঠ নীতিমালা সাংবাদিকদের পূর্ণস্বাধীনতা।

লেখক: সভাপতি রিপোর্টার্স ইউনিটি কক্সবাজার,নির্বাহী সম্পাদক দৈনিক কক্সবাজার৭১

ই-মেইল:hmnazrulcoxs@gmail.com,মোবাইল: ০১৮৬২৩১১১৫১