ডেস্ক নিউজ:

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইনের মত ভয়ঙ্কর নেশায় যুক্ত হয়ে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে বিস্তার লাভ করেছে শক্তিশালী মাদকসেবন ও ব্যবসার সিন্ডিকেট। বেপরোয়া মাদকসেবীরা  প্রকাশ্যেই গ্রহণ করছেন মাদক। সন্ধ্যা নামলেই ক্যাম্পাসের বাতাসে ছড়াতে থাকে গাঁজার গন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই পরিবর্তন ডটকমকে জানিয়েছেন এমন সব অভিযোগ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্ট চত্বর, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, টার্জান পয়েন্ট, আলবেরুনী হল সংলগ্ন মাঠ, স্কুল-কলেজ মাঠ, বিশমাইল মাঠ, সুইমিংপুল, সপ্তম ছায়ামঞ্চ, মুক্তমঞ্চ, যাত্রী ছাউনিগুলো সহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিঘ্নে চলে বিভিন্ন মাদক সেবন। এসব এলাকায় কিছুক্ষণ থাকলেই টের পাওয়া যায় গাঁজার গন্ধ। নেশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বহিরাগতরাও গাঁজাসহ অন্যান্য মাদক সেবন করেন এসব এলাকায়।

ছেলেদের আবাসিক হলগুলোতে বেশ কিছু নির্দিষ্ট কক্ষে প্রতিনিয়ত নেশার আসর বসে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন হলে নিয়মিত নেশার আসর বসে এমন প্রায় অর্ধশত কক্ষের তথ্য পেয়েছেন এ প্রতিবেদক। নেশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু নির্দিষ্ট গ্রুপ রয়েছে ক্যাম্পাসে। এরা সব সময় নিজেদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্ট চত্বরে এদের আনাগোনা থাকে সবচেয়ে বেশি। এসব গ্রুপে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরাও যুক্ত আছেন। এমনকি মাদকসেবন চক্রের সাথে নারী শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে মাত্রাতিরিক্ত মাদকাসক্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারানো ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপ আউট হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে বলে শঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

শঙ্কা প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সেক্রেটারি অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকের বিস্তার ঘটছে এবং এটা ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। ছেলেদের হলগুলোতে এর বিস্তার ভয়াবহ। আমার বিভাগেরই এক ছাত্র; মাদক এমনভাবে তার রক্তে ছড়িয়ে পড়েছে যে সে মানসিক ভারসাম্য পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। বিকেলে হাঁটতে বের হলে আমিও ট্রান্সপোর্টসহ বিভিন্ন জায়গায় মাদকের গন্ধ পেয়েছি।’

এ শিক্ষক আরও বলেন, ‘বিভাগগুলোতে অসম্ভব অমনোযোগী শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে। দুইটা জিপিএ ফাইভ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীরা ড্রপ আউট হয়ে যাচ্ছে, পরীক্ষা দিতে পারছে না, বারবার রিপিট করছে। এসবের পেছনের কারণগুলি কি? এসব বিষয়ে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভাবনার জায়গা নেই। এসব ছেলে মেয়েদের ব্যাপারে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব আছে, কি কারণে তারা এমন হচ্ছে।’

অধ্যাপক ফরিদ সুপারিশ করে বলেন, ‘এটা কন্ট্রোল করতে হলে এ ব্যাপারে প্রচণ্ড সামাজিক চাপ তৈরী করতে হবে। শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে আমার দাবি- হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, প্রক্টরিয়াল বডি এবং পুলিশ প্রশাসনকেও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সম্মিলিত একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষক সমিতি এ ব্যাপারে অত্যন্ত সিরিয়াসলি কাজ করবে।’

এদিকে সচেতন শিক্ষার্থীরা মনে করছেন মাদক নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপের অভাব রয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

জাহিদ আল ইসলাম লিয়ন নামের এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রশাসনের উদাসীনতার কারণেই ক্যাম্পাসে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটতে পেরেছে। রাতের বেলা হলগুলোর বিভিন্ন ব্লকে হাঁটলেই গাঁজার গন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়া সেন্ট্রাল ফিল্ড, মুক্তমঞ্চ, ট্রান্সপোর্ট চত্বরের মত পাবলিক প্লেসেও তারা মাদকসেবন করে। ক্যাম্পাসে যে ছিনতাই বেড়ে গেছে এর পেছনেও রয়েছে মাদকসেবীরা। মাদকের টাকা জোগাড় করার জন্য এরা ছিনতাই করে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহিন নিজের অসহায়ত্বের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে নিরাপত্তা শাখা থেকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এমন কিছু শিক্ষার্থী এসবের সাথে জড়িত যে ব্যবস্থা নিতে গেলে আমাকেই লাঞ্ছিত হতে হবে। আমি নিজেই ফেঁসে যাব। ক্যাম্পাসেরই অনেক অধিবাসী এসবের সরাসরি ইউজার। আমি সেখানে হাত দিতে গেলে দেখা যাবে আমার চেয়ারটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘গত পাঁচ মাসে অন্তত ১৫-২০ জন বহিরাগতকে মাদক গ্রহণের সময় আমি ধরেছি। এছাড়া অনেককে তাড়িয়ে দিয়েছি। বহিরাগত ধরতে গেলেও দেখা যায় বিভিন্ন উঁচু জায়গা থেকে ফোন আসে। দেখা যায় তারা ক্যাম্পাসেরই কারো না কারো সাথে সম্পর্কিত।’

প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার খসরু পারভেজ বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে কনসার্ন আছি। এ সমস্যাটা মোকাবেলা করতে হলে আসলে হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষার্থী সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে।’

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তপন কুমার সাহা মাদক নিয়ন্ত্রণ তার সরাসরি দায়িত্ব না জানিয়ে বলেন, ‘প্রক্টর অফিস ছাত্র শৃঙ্খলা দেখবে। মাদক দেখার জন্য তো আমরা ওইভাবে অ্যাসাইন (দায়িত্বপ্রাপ্ত) না। কিন্তু আমরা হাতেনাতে পেলে ব্যবস্থা নিয়ে নিই। ওটার জন্য কমিটি আছে প্রশাসনের। আমরা দশজন এসিস্ট্যান্ট প্রক্টর; আমরা অভিযান চালিয়ে বেড়ালে তাইলে আর কি কাজ করব আমরা?’

এ ব্যাপারে এ প্রতিবেদককে রেজিস্টারের সাথে কথা বলতে বলেন প্রক্টর।

রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘এগুলো আমাদের জানা আছে। মাঝে মাঝে অভিযান চালানো হয়। আমরা আরও অভিযান চালাব। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছেও আমরা তথ্য পাঠাব।’