প্রভাষ আমিন

আফিয়া জাহিন চৈতির মৃত্যুর পর সেন্ট্রাল হাসপাতালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের হামলা, ভাঙচুর, ডাক্তারদের মারধোর, আবার তাদের বিরুদ্ধেই মামলার ঘটনায় আমি তীব্র নিন্দা জানিয়েছি, লিখেছি। সহপাঠীর অকাল মৃত্যুর পরও তারা সহানুভূতি তো পায়ইনি, উল্টো ভর্ৎসনার শিকার হয়েছে। প্রমাণের আগেই যেসব গণমাধ্যম `ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু` লিখেছেন, লেখায় তাদেরও সমালোচনা করেছি।

এ ঘটনায় সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট ডাক্তারদের পক্ষেই। এটাই ভালো লেগেছে, মানুষ ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করতে পেরেছে এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ফেসবুকে, ডাক্তারদের কাউকে কাউকে অকালে মরে যাওয়া চৈতির চরিত্রে কালিমা লেপনের যে চেষ্টা করতে দেখেছি, তা খুবই দুঃখজনক। সংখ্যাটা অল্প, কিন্তু তবুও এটা দুঃখজনক। আপনার পক্ষে যখন যুক্তি থাকবে না, তখন আপনি গালি দেবেন, অপবাদ দেবেন। কিন্তু এ ঘটনায় তো ডাক্তারদের পক্ষে অনেক যুক্তি আছে। তাহলে অপবাদ দিতে গেলেন কেন?

এ ঘটনায় ফেসবুকে ডাক্তারদের কেউ কেউ যে ভাষায়, যে স্টাইলে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তা সবসময় শোভন নয়। ডাক্তাররা বিশেষ পেশার মানুষ। তাই আমাদের শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ আসনটি তাদের জন্যই বরাদ্দ। আপনি যত বড়ই হোন, ডাক্তারের চেম্বারের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতেই হবে। আমরা চাই না, কোনো ডাক্তারের কথা, আচরণ, শব্দচয়নে তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার সেই আসনটা টলে যাক। ডাক্তাররাও যদি সাধারণ মানুষের মত কথায় কথায় ক্ষেপে যান, গালি দেন; তাহলে আমাদের মত আমজনতার সাথে তাদের পার্থক্য থাকে কোথায়?

সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনার পর থেকে, ডাক্তারদের একটা অংশ ঢালাওভাবে সাংবাদিকদের গালি দিয়েই যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে, ওনারাই সব জানেন, আর পৃথিবীর সবাই মূর্খ। আমরা ডাক্তারদের ঈশ্বরের পরের আসনে বসাই, কিন্তু তারাও যদি নিজেদের ঈশ্বর ভাবতে থাকেন, তাহলেই তো সমস্যা। এটা ঠিক, ডাক্তারদের অনেক পড়তে হয় এবং তাদের পড়ার কোনো শেষ নেই। আমাদের ডাক্তার বন্ধুরা দেখি এখনও পড়ছেন। কিন্তু ডাক্তাররা যদি নিজেদের সবজান্তা পণ্ডিত মনে করেন, আর সবাইকে মূর্খ ভাবেন; তাহলে তো বিপদ। ভালো ডাক্তার যেমন আছেন, খারাপ ডাক্তারও আছেন; খারাপ সাংবাদিক যেমন আছেন, ভালো সাংবাদিকও তো আছেন। মাস্তান ছাত্র যেমন আছেন, ভালো ছাত্রও তো আছে। আচ্ছা, মানলাম সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনায় ভুল চিকিৎসা হয়নি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আইন হাতে তুলে নিয়ে অন্যায় করেছে, সাংবাদিকরা ভুল লিখেছে। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, যখন সত্যি সত্যি ভুল চিকিৎসা হয়, ডাক্তাররা নানা অনিয়ম করে; তখন কি আপনারা তার বিপক্ষে দাঁড়ান? নাকি তখনও সেই ডাক্তারের পক্ষে বলেন বা চুপ করে থাকেন? ভাই বিষয়টা ন্যায়ের। সাংবাদিক ভুল করলে তাদের বিরুদ্ধে বলবেন, ছাত্ররা মাস্তানি করলে তাদের বিরুদ্ধে বলবেন, পুলিশ অন্যায় করলে সমালোচনা করবেন, ডাক্তাররা ভুল করলে সেটাও বলতে হবে।

ডাক্তারদের ভুলটা তারাই ভালো ধরতে পারবেন। আচ্ছা, আমরা যতই মূর্খ হই, গজ ভেতরে রেখে সেলাই করে দেয়াটা যে ভুল, সেটা তো বুঝি। তখন কি আপনারা ডাক্তাররা সেই অদক্ষ ডাক্তারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, নাকি তার অপরাধটা আড়াল করার চেষ্টা করেন? ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে, ঔষধ কোম্পানি থেকে ডাক্তারদের কমিশন খাওয়ার বিষয়টি তো ওপেন সিক্রেট। আমরা না হয় মূর্খ, ভাসা ভাসা জানি। আপনারা তো ভেতরের অন্ধকারের পুরোটা জানেন, কখনো এ অনৈতিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন? ছাত্ররা আইন হাতে তুলে নিয়ে ভাঙচুর করলে সেটা অবশ্যই অন্যায়। কিন্তু ডাক্তাররা যখন রোগীর স্বজনের গায়ে হাত তোলে, সেটা অন্যায় নয়? কই তখন তো আপনারা প্রতিবাদ করেন না, বরং সবাই মিলে সেই অন্যায়কারীর পাশে দাঁড়িয়ে যান, প্রয়োজনে ধর্মঘট করে তাকে মুক্ত করেন। অন্যায়কারীর পাশে দাঁড়াবেন না; তিনি পুলিশ, সাংবাদিক, ডাক্তার, ছাত্র যেই হোন। অন্যায়কারীকে মুক্ত করবেন না, আপনার বিবেক মুক্ত করুন। বিবেচনাটা ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠি, পেশার বাইরে রাখুন। আপনি যে পেশার মানুষই হোন, ন্যায়ের পাশে, অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ান। এটাই ন্যায্যতা। সমপেশার লোক ভুল করলেও তার পক্ষে দাঁড়ানোটা অন্যায়, চুপ করে থাকাটাও।

বুকে হাত দিয়ে বলুন তো বাংলাদেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষা ও অবকাঠামো নিয়ে আপনারা, যারা সেখানে পড়ছেন, তারা কি পুরোপুরি সন্তুষ্ট? ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাথে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মানের কতটা পার্থক্য? বাবার টাকা থাকলেই ডাক্তার হওয়া যায় বটে, কিন্তু ভালো ডাক্তার হতে অনেক সাধনা করতে হয়। আপনারা কয়জন করছেন সেটা? বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার মান উন্নয়নের দাবিতে, সামগ্রিকভাবে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের দাবিতে, কমিশন বাণিজ্য বন্ধের দাবিতে, সত্যিকারের ভুল চিকিৎসার বিরুদ্ধে মাঠে নামুন, মানববন্ধন করুন, কথা বলুন; আমরা আপনাদের পাশে ছিলাম, আছি, থাকবো। সাংবাদিকদের, ছাত্রদের প্রতিপক্ষ ভাববেন না। তারা আপনাদের ভাই, বন্ধু, স্বজন।

বাংলাদেশে অনেক আন্তর্জাতিক মানের ডাক্তার আছেন। কিন্তু গলদ আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। এটা তো সবাই মানবেন, বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের চিকিৎসা ভালো, ভারতের চেয়ে থাইল্যান্ড ভালো, থাইল্যান্ডের চেয়ে সিঙ্গাপুর ভালো, সিঙ্গাপুরের চেয়ে যুক্তরাজ্য ভালো, যুক্তরাজ্যের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভালো। ভালোর কোনো শেষ নেই। কিন্তু ঐসব দেশেও তো চিকিৎসাধীন অবস্থায় মানুষ মারা যায়। যত ভালোই হোক, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষেরই তো দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার সামর্থ্য নেই। আমার বয়স প্রায় ৫০। ছেলেবেলা থেকেই নানান অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত। ১৯৭৬ সালে নেফ্রাইটিসে মরতে বসেছিলাম। ছেলেবেলা থেকে অ্যাজমায় ভুগছি। ১২ বছর ধরে কষ্ট পাচ্ছি ব্যাকপেইনে। মেরুদণ্ডে দুটিসহ আমার শরীরে ছোট বড় ১১টি অপারেশন আছে। কিন্তু চিকিৎসার জন্য আমি কখনো দেশের বাইরে যাইনি।

আমার মত কোটি কোটি মানুষ, যাদের দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের চিকিৎসার জন্য দেশের ডাক্তার ও হাসপাতালের ওপরই নির্ভর করতে হয়। তবে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে গেলেই ধসে পড়বে, দেশপ্রেম অত ঠুনকো নয়। আর সুযোগ থাকলে দেশেই চিকিৎসা করাতে চাই আমি। সে জন্য সবাই মিলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অনিয়মগুলো দূর করতে হবে। সেদিন ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলছিলেন, তিনি যখন ছাত্র, তখন এক শিক্ষক তাকে বকা দিয়েছিলেন। বকা খেয়ে খুব মন খারাপ হয়েছিল তার। পরে সেই শিক্ষক ডেকে ডা. আব্দুল্লাহকে বলেছিলেন, আমি চাই তুমি ভালো ডাক্তার হও, যাতে পরে আমি অসুস্থ হলে তুমি চিকিৎসা করতে পারো।` আমরাও চাই, আমাদের তরুণরা তেমন ডাক্তার হোক, যাতে নিশ্চিন্তে সবাই তাদের কাছে যেতে পারে। আর তাদের মনোভাব হতে হবে ডা. ইব্রাহিমের মত। যেন রোগীদের সেবা করার সুযোগ পেয়ে তারা কৃতজ্ঞ থাকেন। এ ব্যাপারে ডাক্তারদের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। পেশার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে তারা খারাপ ডাক্তারদের চিহ্নিত করত পারেন ও ব্যবস্থা নিতে পারেন, যাতে তেমন কেউ পুরো চিকিৎসক সমাজের বদনাম করতে না পারে।

Amin

২৩ মে, ২০১৭
probhash2000@gmail.com