ইমাম খাইর, সিবিএন:
মহেশখালীর মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে ৪৬কোটি টাকার দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালতে আত্নসমর্পণ করতে এসে কারাগারে যাওয়া সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোঃ রুহুল আমিনের শেষ ভরসা এখন হাইকোর্ট। কক্সবাজারের দুই আদালতেই তার জামিন নাকচ হয়ে গেছে।
বুধবার (২৪ মে) বেলা ১ টার দিকে মিস মামলা নং ২০৮৬/১৭ মূলে জেলা জজ আদালতে তাঁর জামিন চাওয়া হয়। দীর্ঘ শুনানী শেষে বিচারক মীর শফিকুল আলম আবেদন নামঞ্জুর করেন। নিম্ন আদালতে তার আর কোন জামিনের সুযোগ নেই।
খুব তড়িঘড়ি করে নিম্ন আদালত থেকে জামিন নিয়ে কারামুক্ত হওয়ার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল ডিসি মোঃ রুহুল আমিনের।
একটি সুত্র জানায়, বৃহস্পতিবার সকল ডকুমেন্ট উচ্চআদালতে পাঠানো সম্ভব হলেও জামিন আবেদন শুনানী করা নিয়ে আশংকা রয়ে গেছে। পরের দুই দিন শুক্রবার ও শনিবার সরকারী বন্ধ। একারণে আরো অন্তত ৩দিন কারাগারে থাকতে হচ্ছে ডিসি মোঃ রুহুল আমিনকে।
সব মিলিয়ে কক্সবাজারের আদালত উপযুক্ত বিচার করেছে বলে মনে করছেন মামলার পক্ষের আইনজীবীরা।
দুদকের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এডভোকেট মোঃ আব্দুর রহিম ও এডভোকেট মোঃ সিরাজ উল্লাহ। আসামী পক্ষে ছিলেন- এডভোকেট নুর সুলতানসহ ডজনখানেক আইনজীবী।
ডিসি মোঃ রুহুল আমিন গত ২২ মে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেড আদালতে আত্মসর্ম্পন করতে গেলে বিচারক তৌফিক আজিজ তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এর আগে ২১ মে ডিসি মোঃ রুহুল আমিনকে উচ্চ আদালতের দেয়া জামিনের মেয়াদ শেষ হয়।
গত ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সাবেক ভূমি হুকুম দখল কর্মকর্তা এম এম মাহমুদুর রহমান কক্সবাজার সদর থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নং- ১৯। ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল মামলার চার্জসীট দাখিল করেন দুদকের চট্টগ্রাম উপ-পরিচালক সৈয়দ আহমেদ।
চার্জশিটভূক্ত ৩৬ আসামীর মধ্যে সাবেক ডিসি রুহুল আমিন ২৬নং আসামী। তিনি অর্থমন্ত্রনালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উপ-সচিব।
এ মামলায় গত ১০ মে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ জাফর আলম এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার সাবেক উচ্চমান সহকারী আবুল কাশেম মজুমদার, অ্যাডভোকেট নুর মোহাম্মদ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে দুদক টিম। এ ছাড়াও কক্সবাজার রাজস্ব বিভাগের সাবেক সার্ভেয়ার ফখরুল ইসলামকে গত ৩ এপ্রিল গ্রেপ্তার করে দুদক। এ নিয়ে এ মামলায় পাঁচজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হলো। এদের মধ্যে আবুল কাশেম মজুমদার ও নুর মোহাম্মদ সিকদার জামিনে আছেন।
আদালত ও দুদক সূত্র জানায়, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে ১ হাজার ৪১৪ একর জমিতে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় অধিগ্রহণ করা জমির চিংড়ি, ঘরবাড়িসহ অবকাঠামোর বিপরীতে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয় ২৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫টি অস্তিত্বহীন চিংড়িঘের দেখিয়ে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয় ৪৬ কোটি ২৪ লাখ ৩ হাজার ৩২০ টাকা। এ থেকে নানা কৌশলে ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার ৩১৫ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।
দুদকের পিপি মোঃ আব্দুর রহিম জানান, ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর মাতারবাড়ির ব্যবসায়ী এ কে এম কায়সারুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে সাবেক জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) জাফর আলমসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য দুদককে নির্দেশ দেন।
তিনি আরো জানান, দুদক দীর্ঘ তদন্ত শেষে প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের সঙ্গে সাবেক জেলা প্রশাসকসহ ৩৬ জনের জড়িত থাকার বিষয়টি দেখতে পায়। গত ৩ এপ্রিল তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে তারা অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে।
এ মামলার অন্যান্য আসামীরা হলেন- মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের মিয়াজীপাড়ার আবুল বশরের ছেলে মোহাম্মদ আসিন, একই এলাকার বাদশা মিয়ার ছেলে রিদুয়ান, মৃত আবুল হোছাইন এর ছেলে আশরাফ আলী, কালারমারছড়ার মারাক্কার ঘোনার আনু মিয়ার ছেলে মোঃ সেলিম উদ্দিন, মাতারবাড়ী মাইজ পাড়ার মরহুম ছালেহ আহমদ সামাদ এর ছেলে মোঃ হারুন, আবু ছিদ্দিক এর ছেলে দানু মিয়া, নুরুল ইসলাম এর ছেলে মোঃ রফিকুল ইসলাম, মিয়াজী পাড়ার মৃত জাকির আহমদ এর ছেলে মীর কাশেম, মৃত ওয়াজ উদ্দিনের ছেলে মোঃ সেলিম, মাইজ পাড়ার মোঃ রফিকের ছেলে আমিনুল ইসলাম, মিয়াজী পাড়ার মৃত হাজী ওয়াজ উদ্দিনের ছেলে এরফান, বলির পাড়ার মৃত এলাদান এর ছেলে জকি আলম, মিয়াজী পাড়ার মৃত শফিউল আলম এর ছেলে মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, মৃত শফিউল আলম এর ছেলে মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, চকরিয়া উপজেলার বদরখালী মৃত হাসান আলীর ছেলে আবুল বশর, মাতারবাড়ীর তিতামাঝি পাড়ার মৃত ছালেহ আহমদ এর ছেলে নুর মোহাম্মদ, মাইজ পাড়ার মৃত নুরুল ইসলাম এর ছেলে মহিবুল ইসলাম, মিয়াজী পাড়ার মৃত হাজী আলী আহমদ এর ছেলে মোঃ জমির উদ্দিন ও জি.এম ছমি উদ্দিন, ধলঘাটা ইউনিয়নের মুহুরী ঘোনার মৃত আফলাতুন সিকদারের ছেলে সাবেক চেয়ারম্যান আহসান উল্লাহ বাচ্ছু, মাতারবাড়ী মাইজ পাড়া হাজী আশরাফ জামানের ছেলে রুহুল আমিন, হাজী আশরাফুজ্জামানের ছেলে মোঃ নুরুল আবছার, মৃত রহমত আলীর ছেলে ছালেহ আহমদ সামদ, মিয়াজী পাড়ার মৌলভী মফাজ্জল আহমদ এর ছেলে এস্তেফাজুল হক, হোয়ানকের মৃত মোঃ হোছাইন এর ছেলে মোঃ নুরুল ইসলাম, মাতারবাড়ীর বলির পাড়া মৃত শমশুল আলম এর ছেলে বশির আহমদ, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: জাফর আলম, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোং বাংলাদেশ লি: এর পিডি ইঞ্জিনিয়ার মো: ইলিয়াছ, সাবেক ভূমি হুকুম দখল কর্মকর্তা মোঃ রাজিবুল আলম, মহেশখালী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান, জেলা ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সাবেক উচ্চমান সহকারি আবুল কাশেম মজুমদার, এল.এ শাখার সাবেক কাননগো আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক কাননগো মোঃ আবদুল কাদের ভূঞা, সাবেক সার্ভেয়ার ফখরুল ইসলাম, সাবেক সার্ভেয়ার টিএম বাদশা মিয়া ও এডভোকেট নুর মোহাম্মদ সিকদার।
প্রসঙ্গত মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ী ইউনিয়নে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগি সংস্থা-জাইকা এ প্রকল্পে ২৮ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ঋণ দেবে। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেয়া হবে সাত হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা। বাকি তিন হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা প্রকল্পের বাস্তবায়নকারি সংস্থা কোল পাওয়ার জেনারেশন কম্পানী লিমিটেড যোগান দেবে। আগামী ২০২৩ সাল নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।