ডেস্ক নিউজ :

বিএনপি আসলে কী করছে, তারা কী চায়, কী তাদের লক্ষ্য এমন প্রশ্ন এখন অনেকেরই। সেই প্রশ্ন উদয় হওয়া অবান্তর নয়। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হয় বিএনপি কর্মহীন, নিস্তেজ, উদ্দেশ্যহীন। আসলে তা নয়। যে করেই হোক ব্যর্থ হয়ে যাওয়া পরপর দু’টি দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের পর মামলা-হামলায় বিধ্বস্ত বিএনপির পুনরায় প্রস্তুত হতে ‘সময় নেয়া ছাড়া’ কোনো গত্যন্তর ছিল না। এখন সেই অবস্থা পাল্টেছে। মামলা থাকলেও ৯০ ভাগ নেতাকর্মী জামিনে থেকে রাজনীতি করছেন। দলটির হাইকমান্ড সব পরিকল্পনা সাজাচ্ছে নতুন করে।
জাতীয় নির্বাচনে মনোযাগ দিয়েছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে দলটি সাংগঠনিক ভীত মজবুত করার উদ্যোগ যেমনি নিয়েছে, তেমনি ‘নিরপেক্ষ নির্বাচন’ নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি এবং নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ‘সমঝোতা’ না হলে ‘কার্যকর’ আন্দোলনের ওপর জোর দিয়ে সামনে এগোচ্ছে। দলটির নেতারা মনে করছেন, সরকার চেষ্টা করলেও আরেকটি একতরফা নির্বাচন করতে পারবে না। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে শেষপর্যন্ত একটি সমঝোতায় তাদের পৌঁছতেই হবে। আর নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তারাই সরকার গঠন করবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েই এখন নিজেদের প্রস্তুত করছে বিএনপি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনকারী মাঠের বিরোধী দল বিএনপি আগামী নির্বাচন নিয়ে ‘কট্টর’ কোনো অবস্থানে নেই। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি পূরণ না হওয়ায় ওই নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলনে নেমেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোটসহ আরো বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। বিএনপি পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে অন্য সব বিকল্পের চেয়ে বেশি পক্ষপাতী আলোচনার। আলোচনার টেবিলে বিএনপি যে দু’টি বিষয় ফোকাস করতে চায় তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার এবং শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, চলমান সঙ্কট থেকে উত্তরণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন জরুরি। বিএনপির দাবিই সেটা। কিভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, ইনক্লুসিভ একটি নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য আলোচনা হওয়া উচিত। বিএনপি আলোচনাই চায়।
নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে দল পুনর্গঠনের কাজে হাত দিয়েছে বিএনপি। সারা দেশে পুরোদমে চলছে দল গোছানোর কাজ। বিএনপি নেতাদের মতে, দল গোছানোর প্রায় ৭০% কাজ তারা সেরে ফেলেছেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি ও দল গোছানোর অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে সারা দেশে বিএনপির ৫০টি টিম মাঠে নেমেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দলীয় কোন্দল মিটিয়ে ফেলার পাশাপাশি আন্দোলন ও নির্বাচনের জন্য তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন।
নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়ে দলটি দ্বিতীয়ত গুরুত্ব দিচ্ছে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর দিকে। দলের হাইকমান্ডের উপলব্ধি বিগত সময়ে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের কিছু কিছু দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বিএনপির দাবির পক্ষে সমর্থন আদায়ে যোগ্য ও অভিজ্ঞ নেতাদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি যার যার অবস্থান থেকে কাজ করছে। দায়িত্বের বাইরে যাতে কেউ অযাচিত কোন কর্মকাণ্ড না করতে পারেন সেই বিষয়টিও হাইকমান্ড তদারকি করছে।
দলটির শীর্ষনেতারা বলেছেন, একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বর্তমান সরকার বহির্বিশ্বে ভুল মেসেজ দিয়ে নিজেদের পক্ষে কিছুটা সমর্থন আদায় করলেও গণতন্ত্রের পশ্নে তাদের অবস্থান পাল্টায়নি। বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী রাষ্ট্র মনে করে শক্তিশালী গণতন্ত্রের স্বার্থে বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া উচিত। এ নেতার বক্তব্য অনুযায়ী নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর বেশ চাপ রয়েছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এই চাপ তত বাড়বে। আন্দোলনকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়ের ‘সর্বশেষ বিকল্প’ হিসেবে হাতে রেখেছে বিএনপি। তবে সেই আন্দোলনের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবে বিএনপি। কোনো পরিকল্পনা ছাড়া হুট করে বড় ধরনের আন্দোলনে যাবে না তারা। তৃণমূল থেকে শীর্ষ প্রতিটি পর্যায়ে আলোচনা করে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এরই মধ্যে ২০১৫ সালে সর্বশেষ দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করেছে বিএনপি। এর প্রধান কারণ ছিল কার্যকর পরিকল্পনা ছাড়া হঠাৎ করে আন্দোলনের ঘোষণা চলে আসা। সিনিয়র এবং মধ্য সারির নেতারা আন্দোলনের বিষয়ে তখন খুব একটা অবগত ছিলেন না। পরিকল্পনাহীন আন্দোলন এবং সরকার জুলুম নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় ওই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। এবার আর সেই ভুল করতে চায় না দলটি।
‘ভিশন -২০৩০’
নির্বাচনের পথে বিএনপির ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হিসেবেই দলটি ‘ভিশন-২০৩০’ তুলে ধরছে। ক্ষমতায় গেলে বিএনপি নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে এ উপলব্ধি থেকে এর অবসানকল্পে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার কথা ‘ভিশন ২০৩০’ গুরুত্ব দিয়েছে বিএনপি। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে জনগণের সম্মতি গ্রহণের পন্থা ‘রেফারেন্ডাম’ বা ‘গণভোট’ ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃপ্রবর্তন করার বিষয়টিও থাকছে বিএনপির পরিকল্পনায়।
সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা পূরণে বাংলাদেশের সকল ধর্মবিশ্বাসের মানুষ, পাহাড় ও সমতলসহ সকল অঞ্চলের মানুষ এবং প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে একটি জনকল্যাণমূলক, সহিষ্ণু, শান্তিকামী ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলার কথা তারা বলবে। ক্ষমতায় গেলে সুনীতি, সুশাসন ও সুসরকারের সমন্বয় ঘটাতে চায় বিএনপি। গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সুশাসনের জন্য নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতো সাংবিধানিক ও আধা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি, অনিয়ম ও দলীয়করণমুক্ত করার কথা বলা হবে। দলটির পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং মাথাপিছু আয় পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার ও এর জন্য বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ‘ডাবল ডিজিটে’ উন্নীত করার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত উদ্যোগ নেয়া হবে।
দুর্নীতি দমনে কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি আইন ও পদ্ধতিগত সংস্কার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ন্যায়পালের পদ ও কার্যালয় সক্রিয় করবে দলটি।
ভবিষ্যতে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে কঠোরতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে দলটি। বিএনপি মনে করে, সন্ত্রাসবাদ সব রাষ্ট্রের জন্যই হুমকির কারণ। এ কারণে বিএনপি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে কোনো রকম সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বরদাশত করবে না। বাংলাদেশের মাটি থেকে অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাও মেনে নেবে না। ‘শুধু ধনীদের জন্য শিক্ষা নয়’, দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত, মেয়েদের জন্য স্নাতক এবং ছেলেদের জন্য দশম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, মেয়েদের শিক্ষা উপবৃত্তি কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা হবে।
সুষম, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে যথোপযুক্ত প্রণোদনার মাধ্যমে গোটা কৃষি খাতকে পুনর্বিন্যাস করা হবে। কৃষকদের জন্য শস্যবীমা চালু, অদক্ষ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা হবে।
জাতীয় স্বার্থ ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও যোগাযোগ বাড়াতে কানেকটিভিটি স্থাপন, সম্প্রসারণ ও জোরদার করতে বলিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া, কোনো রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং অন্য কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সমস্যা সৃষ্টি না করা, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সৎপ্রতিবেশীসুলভ সোহার্দ্য, বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলা হবে।
এ ছাড়া পরিবেশদূষণ রোধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দেশের অভ্যন্তরে প্রাপ্ত জ্বালানির সর্বোত্তম ব্যবহার, আবাসন খাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত, ওয়াক্ফ সম্পত্তির পরিচালনা ও ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, দেবোত্তর সম্পত্তিসমূহ হিন্দুশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী পরিচালনার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করাসহ নতুন এক সামাজিক সমঝোতা বা চুক্তিতে উপনীত হতে বিএনপি উদ্যোগ নেবে বলে অঙ্গীকার করা হবে ‘ভিশন ২০৩০’র মাধ্যমে। রোজার ঈদের পরে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ফর্মুলাও তুলে ধরবে বিএনপি। অন্যদিগন্ত