আদিল চৌধুরী

কক্সবাজারে মুক্তিযুদ্ধ
মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ইং
প্রচ্ছদঃ নিয়াজ চৌধুরী তুলি
প্রকাশকঃ মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন খান-শব্দরূপ
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২৬২
মূল্য : ৪০০.০০ টাকা

সাম্প্রতিক সময়ের বই ‘কক্সবাজারে মুক্তিযুদ্ধ’। মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম কক্সবাজারের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘ সময় ধরে। বইটি পাঠে তাই মনে হয়। বইটির কলেবর আন্দাজ করলেই অনুমান করা যাবে যে শ্রম, মেধা ও সময় যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহার হয়েছে এর লাচনায় দেখা যায় এ পুস্তকে ২৪টি অধ্যায় রয়েছে। উপ-অধ্যায় রয়েছে ৬৭টি। স্বাভাবিক ভাবে এই বিশাল মাপের বইটি দিনে কিংবা মাসে অথবা এক বছরে রচনা যে সম্ভব নয় সেটি পেছনে।

সূচীপত্র আবেলার অপেক্ষা রাখে না। দীর্ঘ একটি সময় বইটি রচনা এবঙ গবেষণায় ব্যয় হয়েছে- এটিই স্বভাবিক।

ভুমিকা অংশে লেখক মুক্তিযুদ্ধে কক্সবাজারের গৌরব উজ্জ্বল ভুমিকা, বইটি লিখার ক্ষেত্রে লেখকের অনুপ্রেরণার সূত্র সমূহ বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। সন্নিবেশিত তথ্য সম্পর্কে দিয়েছেন কৈফিয়ৎ। মুক্তিযোদ্ধা অমুক্তিযোদ্ধা ভেদাভেদ নাই, বেতন ভাতার জন্য বৈধ অবৈধ পন্থায় অসংখ্য সুবিধাবাদী মানুষ মুক্তিযোদ্ধার কাতারে নাম লিখিয়ে নিতে পেরেছে বলেও লেখক ভূমিকা অংশে উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে ভূমিকাটি গুরুত্বপূর্ণও বটে।

লেখক শুরুতেই জেলার নামকরণ, পূর্বকথা, প্রতিষ্ঠা, ভৌগলিক বিবরণ, স্মরনীয় ব্যক্তি, কৃষি ব্যবস্থা, নদ-নদী, খাল-বিল, বনভূমি ও গাছপালা শিল্প কারখানা, জনবসতি ও ভাষা, পত্র-পত্রকিা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির বিবরণ। মূল বিষয় উপস্থাপনের সাথে উল্লেখিত বিষয় গুলির সহাবস্থান এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, একজন স্কেচ শিল্পী ছবি আঁকার শুরুতে রং তুলি দিয়ে একটি গ্রাউন্ড তৈরী করেন। সে গ্রাউন্ডের উপরে ছবির মূল প্রতিপাদ্যটি স্থাপিত হয়। আলোচ্য পুস্তকের প্রথম অধ্যায়টি এবং দ্বিতীয় অধ্যায়টি পুস্তকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের গ্রাউন্ড হিসেবে বিবেচ্য বটে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের ‘ঘ’ উপ-অধ্যায়ের একটি বিষয় বিদ্যুৎ চমকের মত আমার চোখের সামনে পড়েছে। বিষয়টি ৬ দফা আন্দোলন নিয়ে। এ অধ্যায়ের ৬৫ পৃষ্ঠায় উখিয়ায় ৬ দফা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছাত্রদের ভূমিকার কথা উল্লেখ রয়েছে। ছাত্রদের আন্দোলনের কথা সকলেই জানেন। তারিখটিও সঠিক আছে। কিন্তু ঐ মিছিলে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়, আদপেই সেই দিন কোন ছাত্র বন্দি হননি। সেদিন মিছিলে ছিলেন এমন অনেককেই জিজ্ঞাসা করে জানা গেছে, ঐ মিছিল হতে কোন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়নি। ইতিহাস অহরহ বিকৃত হচ্ছে। অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাচ্ছে।
এ প্রবণতা বাঙালী চরিত্রের এক মহামারী রূপ বিশেষ। যারা লেখককে এ ধরনের অসত্য তথ্য দিয়েছেন, তারা নিজেদের স্বার্থেই নিজেদেরকে মহান বানিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এ অধ্যায়ের বাকী বিষয়গুলি সঠিক পেয়েছি।

১০৬ পৃষ্ঠার একদম শেষের দিকে টেকনাফের বিষয়ে লেখক একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। এটিও একটি দ্বিধাগ্রস্থ হওয়ার মত বিষয় বটে। এখানেও একটি কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, আলোচ্য গ্রন্থের লেখক অতীতের এ বিষয়গুলো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সংগ্রাম কমিটির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কিংবা সাধারণ কোন মানুষের কাছ হতে সংগ্রহ করেছেন। স্বাধীনতার এত দীর্ঘ দিন পর যারা বলেছেন তাদের অনেকের স্মৃতি বিভ্রম হতে পারে, শোনা কথা হতে পারে কিংবা ঘটনার সাথে নিজের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে মহান নেতা বনে যাওয়ার জন্য কথা গুলো বানিয়ে তোলার প্রচেষ্টারই অংশ বিশেষ হতে পারে বলে মনে করি। এই ঘটনায় বলা হচ্ছে যে, টেকনাফ ইপিআর ক্যাম্প হতে ৪ জন অবাঙ্গালী জোয়ানকে গ্রেফতার পূর্বক টেকনাফ থানায় নিয়ে আসা হয়। জানা মতে, ৪জন অবাঙ্গালী ইপিআর জোয়ানকে বন্দি করা হয় নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ঘুমধুম ইউনিয়নের ফাত্রাঝিরি ইপিআর ক্যাম্প হতে। কক্সবাজার হতে বন্দি হওয়া ৭জন অবাঙ্গালী জোয়ান এবং ফাত্রাঝিরি হতে ধৃত ৪জন অবাঙ্গালী ইপিআর জোয়ান সহ মোট ১১জনকে রামু খুনিয়া পালং ইউনিয়নের তুলাবাগান এলাকায় এনে তাদেরকে চলমান যুদ্ধ নীতি মোতাবেক হত্যা করা হয়। বর্তমানেও ঐ ১১টি কবর চিহ্নিত করা আছে।

১০৬ পৃষ্ঠায় আর একটি তথ্য বিভ্রাট লক্ষ্য যোগ্য। জনৈক ইদ্রিস মোল্লা দৃশ্যপটে হঠাৎ হাজির অথচ ১৯৭১ সালের ১০ই মে পর্যন্ত ইদ্রিস মোল্লা সাহেবের কোন দর্শন এতদাঞ্চলের মানুষ পায়নি। অথচ কি যাদুবলে তথ্য সরবরাহকারী এ পুস্তকের লেখক ইসলাম সাহেবকে ইদ্রিস মোল্লার কারামতি তথ্য দিলেন সেটি বোধগম্য নয়।

১০৮ পৃষ্ঠায় পাকিস্তানী অবাঙালী ইপিআর জোয়ান হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এখানেও স্থান নিয়ে বিভ্রাট রয়েছে। ইউনিয়নের নাম ঠিকই আছে। তবে পানের ছড়া নামীয় স্থানে এ সমস্ত ইপিআর জোয়ানদের হত্যা করা হয় নাই। খুনিয়া পালং ইউনিয়নের তুলাবাগান নামীয় স্থানেই তাদের সমাধিস্থ করা হয়। স্মরণযোগ্য যে এটি কোন সাধারণ ঘটনা নয়। দেশের যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান থাকাকালীন বাঙালী জনগণ তাদের শকুন সদৃশ্য প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করার দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন মাত্র।
১২৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে আরেক চমক।
লোকমান হাকিম মাষ্টার নামীয় আরেক ব্যক্তি নিজেকে জাহির করেন। তিনি বিবৃতি দিয়েছেন যে, এভাবে তাঁর নেতৃত্বে ইনানী গভীর জঙ্গলে ছাত্র, যুব কৃষক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে তার দাবী। অথচ ইনানীর মত পাকিস্তানী ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ এলাকায় লোকমান হাকিম মাষ্টার সাহেব কিভাবে সশস্ত্র ট্রেনিং দিলেন সেটি ভাবার বিষয়।

আমার অনুসন্ধানে জেনেছি যে উক্ত এলাকায় এ ধরনের কোন প্রশিক্ষণ কেউ কাউকে দেননি। এই ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর ইনানী আগমণ নিয়ে অনেক বানোয়াট গল্প তৈয়ার করেছিলেন তার প্রমাণও পাওয়া যায়। এ ধরনের রূপক কথা সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বর্গ। মুক্তিযুদ্ধের মহিমাকে ম্লান করেছেন অহরহ।

এ ব্যক্তি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজাকার আলবদরের তালিকা করার সময় মৌলানা ছালামত উল্লাহ সাহেবের মত সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য সুপারিশ করেন। আবার তিনি নিজেই মৌলানা ছালামত উল্লাহ সাহেবকে রাজাকার তালিকা হতে বাদ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন থানা ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কাছে। (দ্র:- স্বাধীনতা স্মারক, জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার ২০১১ ডিসেম্বর)।
১৩০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ঘটনাবলীতেও যথেষ্ট গড়মিল লক্ষ্য যোগ্য। বলা হচ্ছে জনাব শমশের আলম চৌধুরী ৭টি মার্ক থ্রী রাইফেল দেন জনাব ক্যাপ্টেন আবদুস সোবহানকে। মুক্তিযুদ্ধের দলিল ও ছবি অধ্যায়ের ২৪০ পৃষ্ঠায় এর ব্যত্যয় লক্ষ্য যোগ্য। ০১-০৮-১৯৭১ ইংরেজী সনে জনাব আবদুস সোবহান সাহেবের দেয়া TO WHOM IT MAY CONCERN অংশে দেখা যায় যে জনাব আবদুস সোবহান সাহেব শমশের আলম চৌধুরীর নিকট হতে রাইফেল নিয়েছিলেন ৮টি।

১৩০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত অস্ত্র শস্ত্রের বিষয়েও বিশাল গোমর রয়েছে। কালুর ঘাট যুদ্ধে গুরুতর আহত ক্যাপ্টেন হারুন আহামদ চৌধুরী (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) কে উখিয়াতে জনাব শমশের আলম চৌধুরী নিজ বাড়ীতে নিয়ে আসেন। তাঁর সাথে ইপিআর এর যাবতীয় অস্ত্র ভান্ডার ১টি বেডফোর্ড ট্রাকে করে শামশের আলম চৌধুরীর বাড়ীতে আনীত হয়। কালুর ঘাট রণক্ষেত্রের পতন হলে অস্ত্রবাহী গাড়ীটি লোক চক্ষুর আড়ালে নিয়ে যাওয়া জরুরী হয়ে উঠে। এমতাবস্থায় অস্ত্রবাহী গাড়ীটি টেকনাফ থানার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের আলী মিয়া চৌধুরীর নিকট পাঠান শমশের আলম চৌধুরী। এই এক ট্রাক অস্ত্র আলী মিয়া চৌধুরী হাওয়া করে ফেলেন। জনশ্রুতি আছে এই বিশাল অস্ত্র ভান্ডারের মাত্র ৯টি মার্ক থ্রী রাইফেল নিয়ে, নিজের কাছে রেখে, বাকী সমস্ত অস্ত্র আরকানের নাশকতা সৃষ্টিকারী বাহিনীর (পুরিক্ষা বাহিনী) হাতে বিক্রি করে দেন উক্ত ব্যক্তি। (‘উখিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের টুকিটাকি’, স্বাধীনতা স্মারক, কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, প্রকাশ কাল- ২০১১ সন)।

নারী নির্যাতন ও বীরাঙ্গণা অধ্যায়ের ১৪৬ পৃষ্ঠায় দেখা যায় কমলা বেগম নামের এক মহিলার নাম। আমি অনুসন্ধ্যানে দেখিছি, এই কমলা বেগমের বাড়ী রাজাপালং-এ নয়। কমলা বেগম রতœাপালং গ্রামের ভালুকিয়া ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। আমার জানা মতে, উখিয়া বীরাঙ্গণার সংখ্যা ০৪(চার)।

যাই হোক এ বিশাল বইটি পৃষ্ঠাওয়ারী আলোচনা করতে গেলে পাঠক ধৈর্য্যচ্যুত হবে বিধায় আলোচনা সংক্ষিপ্ত করা হচ্ছে। বইটির বাঁধাই চমৎকার প্রচ্ছদ চার রঙা জেকেট বাধাঁই বইটির সাফল্য কামনা করছি।

আদিল চৌধুরী
তারিখঃ ১০-০৫-২০১৭ইংরেজী।