ডেস্ক নিউজ:
বিএনপি ও আওয়ামী লীগআগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে অন্তত দুটি ইসলামি দলকে নিজেদের দিকে বাগিয়ে নিতে ক্ষমতাসীন দল আ.লীগ চেষ্টা করছে বলে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
ইসলামি দল দুটিকে আওয়ামী লীগের পক্ষে নিয়ে আসতে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি দল কাজ করছে বলেও জানিয়েছে সূত্রগুলো। বিএনপির জোট থেকে ইসলামি দল দুটিকে বিচ্যুত করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের মাস্টার্সের সমমান দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপি-ঘেঁষা কয়েকজন আলেমকে রাষ্ট্রীয় ওই প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা নজরদারিতে আনতে শুরু করেছে বলেও জানা যায়।
টার্গেট খেলাফত মজলিস ও জমিয়ত!
প্রায় ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে জোট ছিল ইসলামী ঐক্যজোটের। এবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টায় আছে সরকারি দল। আগামী নির্বাচনে কওমিপন্থী দলগুলোকে পৃথকভাবে জোটে দেখতে আগ্রহী সরকারের একটি পক্ষ। সেক্ষেত্রে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোরও নীরব সম্মতি আছে। তবে তারা নির্বাচনি সমঝোতা নিশ্চিত করেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে। কাঙ্ক্ষিত আসনগুলোয় আওয়ামী লীগের কোনও নৌকা-প্রার্থী থাকবে না, ক্ষমতাসীন দলটির কাছে এমন আশ্বাসও পেতে চান তারা।

তাই নির্বাচনি ছাড় ও জাতীয় সংসদে আসন বন্টনভিত্তিক সমঝোতা সাপেক্ষে দল দুটিকে বাগিয়ে নিতে চায় আ.লীগ। এক্ষেত্রে দুটি পক্ষকে কাজে লাগাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। একটি হচ্ছে, ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করা ইসলামী ঐক্যজোটকে দিয়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি জোট করা এবং এই দল দুটিকে জোটে যুক্ত করা। অন্য পক্ষ হলো, রাষ্ট্রীয় একটি প্রভাবশালী সংস্থাকে দিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব দেওয়ার মধ্য দিয়ে সংসদ নির্বাচনে পৃথকভাবে খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

সূত্রের দাবি, দুটি ইসলামী দলকে বিএনপি থেকে বাগিয়ে নিতে ইসলামী ঐক্যজোটের দুই প্রভাবশালী নেতা কাজ করতে বেশ আগ্রহী। এমনকি এ নিয়ে এই দুই নেতা সরকারের প্রভাবশালী একজন কর্মকর্তার সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করছেন। নিচ্ছেন বিভিন্ন প্রণোদনাও।

তবে এ বিষয়টি ‘মিথ্যাচার’ অভিহিত করে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার কেন বলবে? ‘ইসলামী ঐক্যজোট সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনকে সামনে রেখে। আর দীর্ঘদিন ধরেই আমরা চেষ্টা করছি অন্তত ইলেকশন অ্যালায়েন্স হোক। খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে নিয়ে একটি জোট করতে চাই আমরা।’

এদিকে ‘বিএনপি-জোট ছাড়ার ব্যাপারে এখনও কোনও ভাবনা নেই’ বলে জানান শরিক খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এগুলো একটি মহলের বানিয়ে বলা কথা। জোট ছাড়ার এখনই কোনও চিন্তা নেই।’

বিএনপি-জোটের একটি অসমর্থিত সূত্রের প্রাপ্ত ভাষ্য, সম্প্রতি জমিয়তের মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমি নিজেদের ঠিকঠাক মূল্যায়ন করতে বিএনপির দায়িত্বশীল পক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন। জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন শরিক হলেও প্রাপ্ত মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ আছে জমিয়তের। যদিও দলটির নির্বাহী সভাপতি মুফতি ওয়াক্কাছ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এ ধরনের তথ্য তার জানা নেই।

জোট থেকে বেরিয়ে আসার কোনও চিন্তা আছে কিনা জানতে চাইলে মুফতি ওয়াক্কাছ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জোট ভেঙে আসা কি এত সোজা? রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনেক কঠিন। সময়ই বলে দেবে কি হবে। তবে আমরা মাথা বিক্রি করবো না, বিএনপির কাছেও না, আওয়ামী লীগের কাছেও না। বিএনপি জোটে কওমি মাদ্রাসার প্রতিনিধিত্বশীল সবচেয়ে বড় দল জমিয়ত। তাই আমাদের অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে।’

গোয়েন্দা সূত্রটির দাবি, কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের মাস্টার্স সমমান স্বীকৃতি দেওয়ার পরই গোটা কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে সরকার। এ বিষয়ে টেলিভিশন টক শো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বীকৃতি প্রাপ্তির প্রশস্তি পর্যালোচনা করে এমন ধারণা পোষণ করছে সরকারের প্রভাবশালী সংস্থাটি। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ইসলামি দলড়ুলো সরকারের ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রত্যাশা করছেন গোয়েন্দারা।

জানা গেছে, বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর প্রবীণ নেতাদের নির্বাচনি আসন, এলাকার পরিস্থিতি, ভোটারদের মনোভাব বুঝতে মাঠে নামছে এই গোয়েন্দা সংস্থা। কোনও কোনও নেতার আসন নিশ্চিত বা পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বে দেখা যেতে পারে কওমির শীর্ষ আলেমদের। এক্ষেত্রে বিবেচনায় রয়েছে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, জাতীয় ঈদগাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তখনকার চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোট কলেবরে বেড়ে ১৮ দলীয় হয়। এরপর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) বেরিয়ে গেলে ভাঙন ধরে জোটে। আর গত বছরের ৭ জানুয়ারি বেরিয়ে যায় ঐক্যজোট।

বিএনপি নেতারা বরাবরই অভিযোগ করেছেন, তাদের দলে ভাঙন ধরাতে চায় সরকার। ২০১৬ সালের ৯ জানুয়ারি দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, ‘যে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে, তাদের হাতেই গণতন্ত্র বারবার নিহত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে।’

এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নতুন করে এ ধরনের খবর পাইনি। তবে সরকার তো প্রতিনিয়তই আমাদের জোট ভাঙতে চায়। এর উদ্দেশ্য একটাই— ক্ষমতায় টিকে থাকা, ক্ষমতাকে ধরে রাখা। তা যেভাবেই হোক। তাদের এটা করার কারণ বিরোধীদলকে দমিয়ে রাখা।’

বিএনপি-ঘেঁষা কয়েকজন আলেম নজরদারিতে
কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন নেতার মধ্যে ভেতরে-ভেতরে ক্ষোভসঞ্চারের অভিযোগ পেয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তারা আশঙ্কা করছে, এই অংশটি আল্লামা শফীকে আবারও বিভ্রান্ত করতে পারে। এ কারণে ধর্মভিত্তিক অন্তত দশ নেতাকে নজরদারিতে আনা হয়েছে। তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে ব্যবস্থা নেবে সংস্থাটি।

যদিও এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন হেফাজতের দায়িত্বশীল এবং ইসলামী ঐক্যজোট ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রভাবশালী দুই নেতা। তারা মনে করেন, হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতিতে খুশি। তারা ইঙ্গিত করেন, বিভিন্ন সময়ে দল পরিবর্তনকারী একজন আলেম রাজনীতিক বিভ্রান্ত সৃষ্টির এই অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার পক্ষে আল্লামা শফীকে প্রভাবিত করা সহজ নয়। আলেমরা বলছেন, ‘কওমি স্বীকৃতির পর সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। এক্ষেত্রে জনমত কিছুটাও হলেও সরকারের দিকে হেলেছে।’

মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, ‘জনমত পরিবর্তন হবেই। সবসময় জনমত স্থির থাকে না। প্রয়োজন সাপেক্ষে জনমত পরিবর্তন স্বাভাবিক।’ একই সুরে মুফতি ওয়াক্কাছ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। আহমদ শফী সাহেবকে সম্মান করে আমাদের দাবি অনুযায়ী স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।’

তরুণ আলেমরাও সরকারের এ সিদ্ধান্তে বেশ খুশি জানিয়ে মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের মাস্টার্স সমমান দেওয়ার কারণে সাধারণ তরুণ আলেমদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে।’