বাংলাট্রিবিউন:

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাদেশ ও এখানকার জনগণের জন্য নিজের ভালোবাসা ও টান নিয়ে ওঠা প্রতিবাদ এবং তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আনুষ্ঠানিক অবস্থান ঢাকার স্বার্থরক্ষায় প্রতিকূল চিত্র হাজির করছে। তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে আত্রাই নদীর প্রসঙ্গ এনে আগেই বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। এবার বাংলাদেশকে রফতানির একমাত্র ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা না করার জন্য মালদার আম ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের এই নেত্রী।
বুধবার (৩ মে) পশ্চিম দিনাজপুরে এক সমাবেশে আত্রাই নদীর আরও বেশি পানি ছাড় না দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের দিকে আবারও অভিযোগের আঙুল তোলেন মমতা। তিনি বলেছেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে বালুঘাট ও আশপাশের এলাকা যেন খরায় না পড়ে সেজন্য আত্রাই দিয়ে আরও বেশি পানি ছাড় দেওয়া উচিত বাংলাদেশের।’
বৃহস্পতিবার (৪ মে) মালদায় সরকারি প্রশাসনিক বৈঠক ও এক জনসভায় আম উৎপাদনকারীদের উদ্দেশ্য করে মমতা মন্তব্য করেন, তারা যেন বাংলাদেশকে রফতানির একমাত্র বাজার না ভাবেন। তার মতে, ‘নেপাল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য দেশগুলোতে নিজেদের রফতানির বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাব্য ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা উচিত আম ব্যবসায়ীদের।’
প্রসঙ্গত, গত মাসে শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে যাওয়ার পর থেকেই মমতার বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান প্রকাশ্যে আসছে। দিন যত যাচ্ছে ততই যেন তা বিস্তৃত হচ্ছে। শুরুতে তিনি পশ্চিম দিনাজপুরে আত্রাইয়ে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করতেন। তবে তা ছিল শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের বৈঠকে। কিন্তু বিষয়টাকে খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন কিংবা এ বিষয়ে কোনও চাপ তৈরি করতেন না।
এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আত্রাই ইস্যু ও বাংলাদেশের বাঁধ নির্মাণকে বালুরঘাটের মানুষের পানি দুর্ভোগের কারণ হিসেবে হাজির করছেন মমতা। বুধবারই প্রথমবারের মতো জনসভায় প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলেন তিনি।

মমতার বাংলাদেশ-বিরোধিতায় অবাক হয়েছেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক পর্যালোচনাকারী কলকাতাভিত্তিক বিশ্লেষকরা। তাদেরই একজন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ তিস্তার পানি দাবি করায় পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসছেন বলে মনে হচ্ছে। আগে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সরকারি অবস্থান এমন ছিল না। সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হওয়ার পর যে কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, এটি তারই প্রতিফলন। স্পষ্টতই মমতা নিজে অথবা কারও পরামর্শে ঢাকা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চাপে রাখতে এই বিষয়টি সামনে আনছেন।’

কলকাতার এই পর্যবেক্ষক আরও মনে করেন, এমন বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকদের জনসমাবেশে মমতার ভাষণ এবং ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-এর মতো প্রশ্নের সামনে তাদের ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব ভালো কিছু নয়। এর কারণে দুই বাংলার সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে বলে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘এতে মানুষ আবেগতাড়িত হতে পারে।’

এদিকে তিস্তা নিয়ে দিল্লিতে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে উত্থাপিত নিজের ‘নতুন প্রস্তাবে’ অনড় রয়েছেন মমতা। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। মমতার প্রস্তাব ছিল— ‘তিস্তার কথা ভুলে যান। পানি নিলে তোরসা ও উত্তরবঙ্গের অন্য নদী থেকে নিন।’ কিন্তু মমতার প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের সরকার গ্রহণ করেনি।

বৃহস্পতিবার মমতা আরেকটি ‘নতুন প্রস্তাব’ হাজির করেছেন। তার নতুন হাতিয়ার পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার আম রফতানি। প্রশাসনিক একটি বৈঠকে আম উৎপাদনকারীরা উল্লেখ করেন, তাদের সবচেয়ে বড় রফতানি বাজার বাংলাদেশ। তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাংলাদেশ সরকার মালদার আম আমদানির ক্ষেত্রে ১০-৫০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি করায় তাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এ কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে তাদের বাণিজ্য।

এ খবর জানার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা আম উৎপাদনকারীদের অন্য দেশগুলোতে রফতানির বিষয়টি বিবেচনা করতে পরামর্শ দিয়েছেন। যারা আম আমদানিতে আগ্রহী তাদের খুঁজে বের করতে বলেন তিনি। আম ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত মালদা থেকে ফল কিনছে এবং এ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশের সঙ্গেও তাদের আলোচনা চলছে।

ব্যবসায়ীদের কাছে এ তথ্য জেনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন মমতা। তাই সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, আবুধাবি, নেপাল ও ইইউ দেশগুলোতে আম রফতানির উদ্যোগ নিশ্চিত করতে বলেন তাদের। আম উৎপাদনকারী ও কর্মকর্তাদের এজন্য কাজ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এরপর এক জনসমাবেশে আম উৎপাদনকারীদের প্রতি একই আহ্বান জানান মমতা।

কলকাতার একজন বিশ্লেষক বলেন, ‘নিশ্চিতভাবে প্রকাশ্য ও জনসমাবেশে মমতার এসব বিষয় সামনে নিয়ে আসা বাংলাদেশকে একটি বার্তা দিচ্ছে। এসব প্রসঙ্গ সামনে এনে এবং দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও কঠিন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদিকে বিব্রত করতে চাইছেন তিনি। কিন্তু এটি মমতার ‘সবার আগে রাজ্যের স্বার্থ’ নীতি, ইস্যু তিস্তা হোক বা আম বেচা, তিনি জনসমাবেশে শুল্ক নিয়ে কথা বলার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন।’

রাজনীতিতে মমতা ও তৃণমূলের সবসময় ‘ইটের বদলে পাটকেল’ ছোড়ার প্রবণতা ছিল। কলকাতার স্থানীয় এক লেখক মনে করেন, পদ্মার ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে আরও বেশি পরিমাণে রফতানির জন্য মমতার আহ্বানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খুব একটা ইতিবাচক সাড়া দেননি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তা ইস্যু দীর্ঘায়িত করায় শেখ হাসিনার অসন্তুষ্টির কথা জানান দেয় এ ঘটনায়। এখন মমতা আম ব্যবসায়ীদের ঢাকায় মনোযোগ কমিয়ে অন্য দেশে রফতানির কথা বলে সবাইকে বার্তা দিতে চাইছেন— পশ্চিমবঙ্গকে বশে আনা যাবে না!’

অবশ্য মমতা বা তার প্রশাসনের কোনও কর্মকর্তা রফতানির জন্য নতুন ক্ষেত্র নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি। ফলে বিদেশি বাজারের আকার নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে এবং চুক্তি হতে কতদিন সময় লাগবে তাও অনিশ্চিত।

এমনকি চুক্তির শর্ত, প্রতিটি দেশে চালান পৌঁছানোর সময় এবং খরচ ছাড়াও বেশকিছু বিষয় জড়িত। সর্বোপরি সীমান্তের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী বাংলাদেশের মতো সৌদি আরবে আম রফতানি কখনোই সহজ হবে না।