আহমদ ছৈয়দ ফরমান
মহান আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। রক্তে-মাংসে দেহগড়া সবাই এক ও অভিন্ন। তবু কেন শ্রেণী বিন্যাস। কেউ মালিক, কেউ শ্রমিক। যারা গরীবের রক্ত চোষে অঢেল সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখে তারা মালিক? আর যারা হাঁড়ভাঙ্গা শ্রম দিয়ে সভ্যতাকে উন্নত করে এবং বাবু সাহেবদের বিলাস বহুল গাড়ি চালার জন্য রাস্ত তৈরি করে তারাই শ্রমিক? তাহলে একটি প্রশ্ন জাগে মানুষের প্রকৃত পরিচয়টা কি? বাবু সাহেব একবার কি চিন্তা করে দেখেছেন প্রতিদিন যা খেয়ে জীবণধারণ করছেন তা কাদের কষ্টার্জিত ফসল এবং যে সুরম্য অট্টালিকায় ঘুমাচ্ছেন এটার নির্মাতা কারা! কিন্তু দূর্ভাগ্য পৃথিবী যখন অবিশ্বাসী, প্রেমহীন, হৃদয়হীন, স্বার্থপরদের দিয়েছে দেশ ও জাতির ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব তখন তারা যুগে যুগে উৎসব করেছেন স্বার্থসিদ্ধির আর শ্রেণী সৃষ্টির। তাই কবি জীবনানন্দ দাশ কত বেদনার সাথে বলেছেন,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা/যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই-প্রীতি নেই/

করুণার আলোড়ন নেই/পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

হে শ্রমিক ভাইয়েরা, একবার ভেবে দেখ, তোমরা যাকে মালিক মনে কর তার কাছে নিজেকে অসহায় ভাবছ তাইনা, তোমাকে ছাড়া কিন্তু সেও অচল। তোমার যেমন তার অর্থ দরকার, তারও তেমনি তোমার শ্রম প্রয়োজন। একে অপরের পরিপূরক, অতএব এই প্রয়োজনের পরস্পর বিনিময় হতে হবে সম্মানজনক ও ইনসাফ ভিত্তিক। এ দুনিয়ায় পুঁজিবাদীরা শ্রমজীবিদের মানুষ মনে করেনা। তারাও মানুষ, তাদেরও মন আছে, সুখ-দুঃখ আছে এটা বুঝতে চাইনা। তাই যুগে যুগে হয়েছে ক্ষোভের বিস্ফোরণ, ১৮৮৬ সালের আমেরিকার শিকাগো শহরের ‘হে মার্কেটে’র নিচে আট ঘন্টা শ্রমের দাবীতে শ্রমিকেরা বুকের রক্ত বিসর্জন দিয়ে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করেছেন শ্রমের মর্যাদা। হে মুক্তির সারথিরা ১৩১ বছর পরেও আমরা তোমাদের ভুলি নাই, যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন ভুলবনা, তোমাদের ঋণ কখনো শোধ হবার নয়। যাদের শ্রম ছাড়া আমাদের জীবন অচল, আজ তারা সমাজে নিগৃহীত, অবহেলিত, বঞ্চিত। দেশের সিংহভাগ মানুষ শ্রমজীবী, তারা আমাদের ভাই, তাদের নাই কোন বিশেষণ। তবে ভোটের আগে তারা দেশের পার্টিগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাদের কুঁড়ে ঘরে এম.পিÑমন্ত্রীরা যায়। তাদের ছোট ছেলে-মেয়েদের থুতনি নেড়ে আদর করে ও মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ভোট আদায় করে। তারপর ভোট শেষ শ্রমিকদের প্রয়োজনও শেষ। এদেশে সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের জীবনের কোন পরিবর্তন হয়না। আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তন হলে সরকারী জায়গায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নামে শ্রমজীবী মানুষের উপর নেমে আসে আরেক দফা নির্যাতন। তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই, বস্তি, খুপড়ি, জীর্ণকুটির, তাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন, পানের দোকান, চনা-মুড়ির দোকান, তরিতরকারীর দোকানে আঘাত হানে সরকারী বুলডোজার। ভূমিদস্যুদের সরকারী জায়গার উপর নির্মিত আকাশ ছোঁয়া দালান কোঠার পাশে আবর্জনার স্তুপের মত ঝুপড়ি দেখে আঁচ করা যায় বৈষম্যের প্রাচীর কতটা দূর্লঙ্ঘ। এমন ঘর নামের আশ্রয়স্থলের পাশেই ভূমিদস্যুদের অধিকৃত দালান কোঠা দাঁড়িয়ে থাকে নির্ভয়ে। আমাদের দেশের হর্তাকর্তারা কখনো বস্তির খুপড়ি ঘরে উঁকি দিয়ে জানতে চাননি যে, এখানে গরীব মানুষগুলো কিভাবে থাকে। আঘাত করা হয় তাদের জীর্ণকুটিরে এই হচ্ছে স্বাধীনতার চার দশকে অবৈধ দখল থেকে স্থাপনা উচ্ছেদের নমুনা। দফায় দফায় এভাবে চলছে উচ্ছেদ। কখনও নোটিশ দিয়ে কখনো বিনা নোটিশে। ফলে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে নিম্ন আয়ের মানুষ পথে বসেছে। বাসস্থান যদি মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভূক্ত হয় তবে দেশের নাগরিক হিসেবে তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। কোন প্রকার পূর্ণবাসন না করে তাদের এভাবে ভিক্ষার ঝুঁড়ি কাঁধে তোলে দেওয়া বিশ্বে বিরল। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,

“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তাদের বেসেছ ভালো?”

দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিপক্ষে আমরা কেউ নয়। যদি সব ধরণের অবৈধ স্থাপনাও দখল উচ্ছেদ করা হয়, যদি নিঃসম্বল মানুষের পূর্ণবাসনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা করা হয় অন্তত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তাই ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের পক্ষে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম তার ক্ষুরধার লেখনিতে এভাবে ফুটে তুলেছেন,

“প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস

যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।”

ছোট কালে দুখু মিয়া নামে পরিচিত। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম শোষক শ্রেণী যারা মানুষের মুখের আহার নিয়ে টানাটানি করে, কলমের ভাষায় তাদের সর্বনাশ কামনা করেছেন, কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য আরো একধাপ এগিয়ে বলেছেন,

“শোনরে মালিক শোনরে মজুতদার/ তোদের প্রসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাঁড়/

হিসাব কি দিবি তার/শোনরে মজুতদার/ ফসল ফলানো মাটিতে রোপন/করব তোকে এবার।

এই কিশোর বিদ্রোহী কবি, এক প্রকার মালিক ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে তার কবিতায় প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আজ পহেলা মে, অধিকাংশ শ্রমিকেরা জানেনা এ দিবসের তাৎপর্য। তাদের নিজের অধিকারের বিষয়ে আরো বেশি সচেতন ও সতর্ক হতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের অধিকার ও দাবী আদায় করাই হোক এবারের মে দিবসের শপথ, এক মুঠো ভাত নয়, জীবন-চিন্তা-স্বপ্ন সকল ক্ষেত্রেই স্বাধীনতার স্বপ্ন জেগে উঠুক হৃদয়ে। অবসান হোক আমাদের বহুমাত্রিক দাসত্বের।

লেখক সাধারণ সম্পাদক, রামু উপজেলা শ্রমিক দল।