পর্ব-২
এইবার কি কি কারণে দ্বীপের এই বেহাল দশা তা আলোচনা করিঃ
১) সেন্টমার্টিন ভাঙনের প্রধান ও অন্যতম কারণ হচ্ছে নাফ নদীর গতি পরিবর্তন। সেটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই বা কারো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না! নাফ নদী নাব্যতা হারিয়ে, গতি পরিবর্তন হয়ে পূর্বদিকে সরে গেছে । আর পূরাতন মোহনা ও গতিপথে সেন্টমার্টিনের চেয়ে প্রায় ১২/১৩ গুণ বড় ডুবো চর বা দ্বীপসৃষ্টি হয়েছে।(গুগল আর্থ ম্যাপ ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে) ফলে সামুদ্রিক স্রোত বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। যে কারণে দ্বীপের দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তরাংশ ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে বা ভেঙে যাচ্ছে। বিষয়টি কারো কাছে হাস্যকর মনে হলেও অতিবাস্তব। গবেষণা করতে হবে না, ভুগোলের স্রোত পড়ে, সেন্টমার্টিনের আগের জোয়ার, ভাটা ও স্রোত হিসেব করলেই ফলাফল যে কেউ পেয়ে যাবে। আগে জোয়ারের সময় মহাসাগরীয় স্রোত বা সামুদ্রিক স্রোত দ্বীপের দক্ষিণ দিক থেকে পশ্চিম পাশ হয়ে, উত্তর দিকে যেত, আবার কিছু অংশ চাঁদের মত বাকা হয়ে বদর মোকাম হয়ে নাফ নদীতে প্রবেশ করত। আর ভাটির সময় নাফ নদীর স্রোত দ্বীপের পূর্বদিক হয়ে দক্ষিণ দিকে চলে যেত,ফলে দ্বীপে তেমন স্রোত আঘাত করত না। এখন দ্বীপের উত্তর পূর্বদিকে চর বা নতুন দ্বীপ সৃষ্টি হওয়ায় মহাসাগরীয় স্রোত বা সমুদ্র স্রোত আগের মত বদর মোকাম হয়ে প্রবেশ করতে পাড়ছেনা, ফলে স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা আগের চেয়েও বেশি হয়, এতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এই বিষয়টি যে কেউ পরীক্ষা করে দেখতে পারে। নালা বা প্রবাহমান জলধারে অথবা স্রোত আছে বা সৃষ্টি করে এমন পানিতে ডুবন্ত কিছু দ্বারা হাল্কা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে এর পাশাপাশি উজানে পানি ফুলে উঠবে বা পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে ও পানি উত্তাল হবে।
২) ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বীপ ভাঙনের জন্য অন্যতম দায়ী। মহাসেন,কোমেন ও রোয়ানোর মত ঘুর্ণিঝড় ঘনঘন আগাত করায়, দ্বীপের রক্ষাকবচ খ্যাত, অদুরবর্তি প্রাকৃতিক পাথরের মজবুত দ্বীপগুলো নড়েবড়ে হয়ে পড়ে, ফলে স্রোত প্রতিরোধের সক্ষমতা হারিয়ে পেলে।
৩) বৈশ্যিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারনে মেরু অঞ্চল বা হিমবাহের বরফ গলে যাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। যা নিয়ে আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশংকা করেন। তাঁদের ধারণা মতে ২০৫০ সাল নাগাদ ২/৩ অংশ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে যাবে। যার প্রভাব ইতিমধ্যে সেন্টমার্টিনে পড়ছে।
৪) ভারী স্থাপনা নির্মাণ দ্বীপের প্রাকৃতিক কাঠামো নষ্ট করে দিয়েছে। যদিও এটি একটি ডুবো পাহাড়ের চুড়া, যার সৃষ্টি টারশিয়ারি যুগে। মানে হিমালয় ও মিয়ানমারের পাহাড় সৃষ্টির সময় সৃষ্ট। কিন্তু যে অংশ(সেন্টমার্টিন দ্বীপ) এখন ভাসমান আছে, সেটা পাহাড়ের মূল চুড়া নয়, কারণ এর কোন প্রমাণ তেমন দৃশ্যমান নায়। সামান্য যা দৃশ্যমান তাকে মূল চুড়া বলা যাই না। আসল চুড়া আরো নিছে, সামান্য ডুবো ডুবো অস্থায়। মূলচুড়ার শীলা ভেঙে পাথর হয়, আর পাথরে প্রবাল জন্মায়, আর ডুবো পাহাড়ের চুড়ায় পাথর ও প্রবালের সাথে নাফ নদী হতে আসা পলি মাটি জমে দ্বীপের সৃষ্টি। আর দ্বীপের মাটি এখনো পুরু হয়নি বা পূর্ণতা পায়নি। ফলে ভারী স্থাপনা নির্মাণ দ্বীপকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, আর ধ্বংস হতে চলেছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ।
৫) পাথর ও বালি উত্তোলন দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিছে। ফলে দ্বীপ ভয়ংকর হুমকির মুখে। চরের পাশাপাশি যে কোন সময় লোকালয়েও পানি ডুকে যেথে পারে! কেননা দ্বীপের চারপাশে থাকা উঁচু বালি টিলাগুলো এখন সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ফলে লোকালয় আর সাগরের মাঝে কোন প্রতিবন্ধকতা নাই। এছাড়া পাথর স্থানান্তর করার কারনে দ্বীপ অনেক নিচু হয়ে গেছে ও কাঠামো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ অংশে জমি দখল করার সময় প্রচুর পাথর স্থানান্তরিত হয়েছে (কেউ রাস্তা করছে আবার কেউ জমির ভাউন্ডারী করছে, আবার কেউ ভেঙে কংক্রিট বানিয়েছে) । ফল স্বরূপ ভুমি তলিয়ে যাচ্ছে আর বৃষ্টির পানির সাথে মাটি সাগরে নেমে যাচ্ছে।
৬) বন উজাড় ও বৃক্ষনিধনও দ্বীপ ভাংনের একটি কারণ। দ্বীপের চারপাশের কেয়াবন ও দক্ষিণের গভীর বন উজাড় করে জমি বৃদ্ধি করার কারণে দুর্যোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। ফলে সামান্য বাতাস যেমন দ্বীপকে আতঙ্কিত করে তোলছে তেমন সামান্য জোয়ারেও পানি লোকালয়ে ডুকছে।
৭) প্রবাল উত্তোলন ও ঝিনুক আহরণও দ্বীপ ভাঙনে দায়ী। প্রবাল চুনাপাথর সৃষ্টি করে, ফলে পাথরের সংখ্যা বাড়ে, এতে দ্বীপের গঠন আরো সুসংহত করে। কিন্তু প্রবাল আহরনের ফলে এইসব কিছুই হচ্ছে না। বরং প্রাকৃতিক ভূমি কাঠামো নষ্ট হচ্ছে। আর মৃত ঝিনুক আহরণে সৈকতের বালি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া কড়ি আহরণ করার সময় পাথরের প্রাকৃতিক ভাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফলে পাথরের স্রোত প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
৮) নিয়মিত খাল খনন না করা ও জলাবদ্ধতাও দ্বীপ ভাঙনের একটি মুখ্য কারণ। বর্ষায় বৃষ্টির পানি ও জোয়ারের পানি খাল খননের অভাবে পানি আটকা পড়ে, এতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ফলে দ্বীপের মধ্য ভাগের বালুগুলো পানির কারনে বুদবুদ সৃষ্টি হয়। এই কারনে সবার অগুচরে দ্বীপের তলা দিয়ে বালি বের হয় যায়, আর পানির চাপে অনেক মাটি সাগরে তলদেশেচলে গেছে। ফলে দ্বীপ অনেকাংশ তলিয়ে গেছে এবং ধেবে গেছে। আর জোয়ারের সময় নতুন করে ভাঙন হচ্ছে। উদাহরণসরুপ নতুন পুকুর খনন করলে দেখা যায় পানির সাথে মাটি তরল আকারে চলে আসে।
পরের পর্বঃ কিছু প্রকল্পের সমালোচনা।

ভাঙনের কবলে পড়ছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ! বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভেঙে যাচ্ছে দ্বীপ, কিছু মানুষের প্রভাবে ভেঙে পড়ছে সমাজ, আর পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশে ভাঙতে হচ্ছে হোটেল! আতঙ্কে ভেঙে যাচ্ছে আমাদের হৃদয়।

চোখ রাখুন আগামী কালের ৩য় পর্বে

লেখক :
তৈয়ব উল্লাহ, সভাপতি সেন্টমার্টিন স্টুডেন্ট ফোরাম।
তার পেইজবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত।