ইমরান হোসাইন, পেকুয়া:

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। যেই সন্ধ্যা নেমে আসে বাতাসের গতিবেগও বাড়তে থাকে দ্রুত। সন্ধ্যার পর থেকে সাগরের পানিও বাড়তে শুরু করে। শুরু হয় উপকূলবাসীর উৎকন্ঠার রাত। রাত ৮টার দিকে বেড়ে যায় বাতাসের গতি। সে সাথে সাগরের গর্জন। লোকজন ছোটাছুটি করে আশ্রয় নেয় আশ্রয় শিবিরে। প্রয়োজনের তুলনায় আশ্রয়ণকেন্দ্র অপ্রতুল হওয়ায় লোকজন নিজ নিজ ঘরে থেকে যায়। রাত ১০ টার দিকে সাগরের উচুঁ ঢেউ একের পর এক প্রচন্ড বাতাসের সাথে আছড়ে পড়তে থাকে উপকূলে। এক সময় বাতাসের গতি আরো বেড়ে যায়। সে সাথে বাড়ে পানির ঢেউ। একেকটি ঢেউ ওঠে আসে পর্বত সমান করে। এভাবে ঢেউয়ের আঘাতে আমাদের ঘর মুহূর্তেই চুরমার হয়ে ভেসে যায়।

ভোরের দিকে বাতাসের গতিবেগ কমার সাথে সাথে পানির ঢেউও কমে যায়। এরইমধ্যে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ম্যারি এন তছনছ করে দিয়েছিল উপকূলীয় জনপদ। নিহত হয়েছিল কয়েক লাখ মানুষ। ভেসে গিয়েছিল ফসলের ক্ষেত, লাখ লাখ গবাদি পশু। সেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তান্ডবে প্রাণ হারিয়েছিল কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার পাঁচ হাজারেরও অধিক মানুষ।

কথাগুলো বলছিলেন ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল উপকূলে আঘাত হানা প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ম্যারি এন এর প্রত্যক্ষদর্শী ও মগনামা পশ্চিমকুল এলাকার বাসিন্দা মৃত কিবরিয়া আহমদের পুত্র মাষ্টার আকবর আহমদ।

তিনি আরও বলেন, ১৯৯১ সালের ঘুর্ণিঝড়ে ১২ জন নিকট আত্মীয়কে হারিয়েছি। হারিয়েছি সহায় সম্পদ। সেই দুঃসহ স্মৃতির প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের ছাব্বিশ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো নিরাপদ মনে করতে পারছিনা নিজেকে বা নিজের পরিবারকে। অধিকাংশ বেড়িবাঁধ অরক্ষিত। নেই প্যারাবন। বিগত আট বছরে তিনবার পড়তে হয়েছে বন্যার কবলে। আগামী বর্ষার প্রথম ধাক্কাতেই তলিয়ে যাবে বসতঘর। বেড়িবাঁধের সংস্কার কাজ চললেও এখনো অরক্ষিত রয়ে গেছে উপকূল। গতবছরের দীর্ঘমেয়াদী বন্যা মোকাবিলা করে এলাকার মানুষ সর্বশান্ত হয়েছে। তাই এখন আতঙ্কে দিন কাটাছে আমাদের।

একই এলাকার বাসিন্দা সুলতান আহমদ বাদশা, মো. ইসমাঈল বলেন, গতবছরের বন্যায় বসতঘরটি ভেঙে পড়েছিল। এখন বিভিন্নজনের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে বসতঘরটি তৈরী করেছি। কিন্তু চলতি বছর যথাসময়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় বর্ষায় আবারো বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছি আমরা। আবারও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হবে মগনামা ইউনিয়ন। এখন বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, মগনামা ইউনিয়নের চেপ্টাখালী নাশি থেকে কাকপাড়া পয়েন্ট পর্যন্ত (২.৭ কিলোমিটার) বেড়িবাঁধ অংশটিতে দুইটি স্কেভেটর দিয়ে মাটি ভরাটের কাজ করা হচ্ছে। বেড়িবাঁধের চেপ্টাখালী নাশি থেকে মগনামা লঞ্চঘাট পর্যন্ত (১.২৫ কিলোমিটার) অংশটিতে লিভার সাইটে (বাঁধের বাইরের অংশ) ব্লক বসানোর কাজ চলছে।

সরেজমিনে আরও দেখা যায়, কাকপাড়া বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ ও শরৎঘোনা এলাকার বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ এখনও মেরামত করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ দুইটি স্থানে কোনো কাজই শুরু করেনি। কাকাপাড়া এলাকার মো. ছরওয়ার বলেন, সরকার বেড়িবাঁধ নির্মানে অন্তত ২০০ কোটি টাকা বরাদ্ধ দিলেও কোনো কাজ করেনি ঠিকাদার। এতে আবারও প্লাবিত হবে লোকালয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, পেকুয়া উপজেলায় ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ২০ কিলোমিটার অংশে বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। এ জন্য বরাদ্ধ করা হয়েছে একশত ৯০ কোটি টাকা।

মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম বলেন, বেড়িবাঁধের কাকপাড়া ও শরৎঘোনা এলাকার দুটি পয়েন্টে এখনও কোনো কাজ করা হয়নি। অন্য যেসব এলাকায় কাজ করা হয়েছে, তাও ৪০ শতাংশের বেশি হবে না। এছাড়া বেড়িবাঁধের কাজে চরম দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে চোর ডাকাতরা সরকারি বরাদ্ধ লুটপাট করছে। এরচেয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করলেই ভালো ছিল। অন্তত সরকারি অর্থ রক্ষা হতো। বর্তমানে উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১৩ কিলোমিটার অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রতি বর্ষায় কাকপাড়া বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে উজানটিয়ার ৩০ হাজার মানুষ পানিতে হাবুডুবু খায়। সরকার জরুরি ভিত্তিতে কাকপাড়া বেড়িবাঁধে ২৮০০ ফুটের একটি রিং বাঁধের জন্য ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্ধ দিলেও ঠিকাদার কাজ করেনি। এ নিয়ে কারও মাথাব্যাথা নেই। এবারের বর্ষায়ও মানুষ সাগরের পানিতে ভাসবে-এটা নিশ্চিত।

পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ রাজু বলেন, বেড়িবাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় আতঙ্ক ও শঙ্কা বিরাজ করছে উপকূলের মানুষের মধ্যে। বর্ষায় তাঁরা কি করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। দ্রুত বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তদারকির আহ্বান করছি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও (পেকুয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত) গিয়াস উদ্দিন বলেন, কাকপাড়া এলাকার ভাঙা অংশটি এ বর্ষার আগে কাজ শুরু করা সম্ভব নয়। তবে ২৮০০ ফুটের রিং বাঁধের নির্মাণ কাজ আজ (গতকাল) থেকে শুরু হয়েছে। আগামী ২০দিনের মধ্যে কাজ শেষ হবে। গিয়াস উদ্দিন বলেন, বর্ষার আগে সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। ফলে বন্যা থেকে রক্ষা পাবেন উপকূলের মানুষ।