উপকুলীয় দ্বীপ

এর ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত জনজীবন ।

হারুনর রশিদ,মহেশখালী

কাল ভয়াল ২৯শে এপ্রিল। স্বজন হারা লোকজন বুকে মাটি চাপাদিয়ে পার করল দীর্ঘ ২৭টি বছর। উপকুলীয় দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর লোকজন এখনো শিউরে উঠে ; ১৯৯১ সালের ভয়াল ২৯শে এপ্রিল এর ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত জনজীবন এর কথা মনে পড়লে।

ভয়াল ১৯৯১ সনের ২৯ এপ্রিল। এইদিনে দ্বীপ-উপজেলা মহেশখালীর ওপর দিয়ে বয়ে যায় স্মরণকালের এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। প্রায় ৮ঘন্টার স্থায়ী ঘূর্ণিঝড় বাতাসের তীব্র তান্ডবে দ্বীপের নারী-পূরুষ ও অসংখ্য শিশুসহ প্রাাণহারায় ১২হাজার এর অধিক মানুষ। সে সাথে সমস্ত গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী ও জীব-জন্তুর মৃতে্যুসহ বিধ্বস্ত হয় সমস্ত কাচা ও পাকা ঘর-বাড়ী, অফিস-আদালত, রোড-ঘাট ও দ্বীপ-রক্ষার বেঁড়ীবাঁধ। মুহুর্তেই লন্ড-ভন্ড করে দেয় দ্বীপবাসীর স্বপ্ন। এই মহা দূর্যোগের ২৭টি বছর অতিবাহিত হলেও দ্বীপবাসীর মাঝে এখনো বেদনা-বিধুর শোকের ছায়া। ৯১’র আগের প্রজন্ম এর কাছে ভিবিষিকাময় একটি রাত, এই প্রজন্ম বয়সকাল শেষ হয়ে গেলে এটি রুপকথার গল্প হিসেবেও পরবর্তী প্রজন্মকে জানতে শেখাবে।

বাংলা সনের চৈত্র-বৈশাখ মাসের তীব্র গরমে মাঠ ঘাট ফেটে চৌছির ছিল ওই ঘুণিঝড়ের সময়। শুকনো ছিল খাল,বিল,নদী নালা ও পুকুর। সারা দিন আকাশে মেঘ জমাছিল,ঘুটিঘুটি হালকা বৃষ্টি ও পড়ছিল সারা দিন। সপ্তাহের সোমবার দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা যতই ঘনিয়ে আসছে, বাতাসের একটানা গতিবেগ ততই তীব্রতা বাড়তে থাকে।

রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সেচ্ছাসেবি কর্মীরা প্রচার করতে থাকে দূর্যোগের খবর। কিন্তু ভুক্ত ভুগিরা কেউ পাত্তাই দিল না- করল অবহেলা। ওই অবহেলায় কাল হল অনেকেরই। দীর্ঘ প্রায় ৩১ বছর পর এতো ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়/তুফান হতে পারে তা মানুষ বুঝতে পারেনি। এলাকার বয় বৃদ্ধরা বলতে শুনেছি ১৯৯১ সালের আগে ঘূণিঝড়টি হয়েছিল ১৯৬০সালে। সে কারণে তেমন আত্মরক্ষার চেষ্টা করেনি মানুষ।

ভয়াল ২৯শে এপ্রিল

স্বজন হারা মানুষেরা বুকে মাটি চাপাদিয়ে পার করল দীর্ঘ ২৭টি বছর

১৯৯১সালে ২৯শে এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টার দিকে শুরু হয় বাতাসের প্রচন্ড ধমকাহাওয়া। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বৃষ্টি ও তীব্র ধমকা হাওয়া শুরু হয়েগেলে; তখন কোথাও বেরুবার কায়দা ছিলনা মানুষের। ঠিক রাত সাড়ে ৯টার দিকে হঠাৎ দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে তীব্র গতিতে লোকালয়ে ওঠে আসে বঙ্গোপসাগরের কাঁধা মিশ্রিত লোনা পানি। সাগর আর তীর একাকার হয়ে যায় ওই ঘূণিঝড়ে। তখন ঘরের ছাদ ও গাছ-পালাসহ যে যেখানে পায় আশ্রয় নেয় মানুষ। ঝড় আর বাতাসেন তীব্রগতিতে মানুষ ও পশুপাখিদের আশ্রয়স্থল থেকে ও ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘুর্ণিঝড়ের পানিতে। এভাবে সলিল সমাদিঘটে দ্বীপের কয়েক হাজার মানুষের।

সুত্রে জানা যায়, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে উপজেলার ধলঘাট,মাতারবাড়ি ও কুতুবজোম ইউনিয়ন লন্ডভন্ড হয়ে যায় এবং প্রায় ১২ হাজার মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এসময় বসতবাড়ি ভেঙ্গে গিয়ে গৃহহারা হয়ে পড়ে কুতুবজোম,মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ। পরে ১৯৯৭, ৯৮, সালে আরো দু’টি বড় বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে কক্সবাাজারের এই উপকূলে। এরপর সিডর, বিজলী,আইলা ও রোয়ানু, নার্গিজ আঘাত হানে মহেশখালী উপকূলে। এতে অন্তত ১০ থেকে ১৫ হাজার ঘরবাড়ি ভেঙ্গে যায়। এরপর অনেকেই পুণরায় বসতবাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করলে ও যাদের সম্বল নেই,তারা বেড়িবাঁধের বাইরে ঢালু ও চর এলাকায় বাঁেশর তৈরি ছোট্ট ছোট্ট ঝুপরী ঘরে মৃত্যুর ঝুঁিক নিয়ে বসবাস করছে।

প্রতি বছর ঘোরে ফিরে ২৯শে এপ্রিল তারিখ আসলে ভিবিষিকাময় কাল রাত্রির কথা মনে পড়ে এবং দীর্ঘ ২৭টি বছর বুকে লালন করছে স্বজন হারা মানুষ।

১৯৯১ সালে স্বজন হারা এক অসহায় পরিবাবের কিছু কথা তোলেধরা হল- মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়নের পূর্বসুতরিয়া গ্রামের বাসিন্দা কালা মিয়া ও তার ছেলে সিরাজুল ইসলামের লন্ডভন্ড হয়ে যায় সোনার সংসার। ঘূর্ণিঝড়ের থাবার নির্ঘাত মৃত্যু থেকে বেঁচে ফিরে আসা সিরাজুল ইসলাম কান্না জড়িত কন্ঠে এ প্রতিবেদক কে (চট্রগ্রামের আঞ্চলিকগানের স¤্রাট চকরিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম আজাদ এর ১৯৯১ সালে গাওয়া একটি গানের কলি গেয়ে শুনালেন- ওরে রাক্ষুসিরে ধরিয়া- সোনার সংসার গরলিরে ছারখার , নিলিরে ভাসাইয়া।

স্বজনহারা সিরাজ আরো জানান- ১৯৯১ সালে সুখের সংসার ছিল আমাদের। পরিবারে বাবা-মা ও আমার পরিবার সহ ছেলে মেয়ে মিলে ৮সদস্য ছিল। ভয়াল ২৯শে এপ্রিল তারিখের সোমবার দিন সন্ধ্যা ৫টার সময় বাতাসের গতীতে আমার টিনের ছাউনি ঘরটির ছাউনি বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তখন পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে পাশের বাড়ীতে আশ্রয় নিই। সে খানেও বেশিক্ষণ আশ্রয় হল না সিরাজের পরিবারের। বাতাসের তীব্রতায় আশ্রয় নেওয়া বাড়ীটি ও ভেঙ্গ যায়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে সাগরের পানি লোকালয়ে ডুকে পড়লে মুহুর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় উপকূল। ওই সময় বাবা-মা এবং সিরাজের স্ত্রী রশিদা বেগম-(৩৩), ছেলে লেদু-(১০), মেয়ে বাগী বেগম-(৮), রুমানা বেগম-(৪), একেক জন একেক দিকে নিয়ে যায় প্রবল ¯্রুোতে, ওই সময় সিরাজের কূলে ২ বছরের মেয়ে মনোয়ারা বেগম কে নিয়ে সিরাজ বাঁশ-গাছ ধরে কোনমতে প্রাণে বেঁচে যায়। ঘূর্ণিঝড় পরবতী স্বজনদের খোঁজ নিতে শুরু করেন- সিরাজ তাঁর বাবা-মা কে জীবিত উদ্ধার করেন পার্শবতী ইউনিয়ন মাতারবাড়ী থেকে। স্ত্রী রশিদা এবং ৩ সন্তান কে মৃত পাওয়া গেলেও ৪বছরের রুমানাকে আর খোঁজে পাওয়া যায়নি। কিছুদির পর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বাবা-মা ও মারা যায়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা মেয়ে মনোয়ারা কে নিয়ে আজও বেঁচে আছি বলে আবেগ আপ্লুত কন্ঠে জানান সিরাজ।

ধলঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান জানান- ঘূর্ণিঝড়ে এতদঅঞ্চলের বসবাস কারীদের ব্যাপক জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল। এখনো মৃত্যুর ঝুকি নিয়ে বেঁড়ীবাঁধের ঢালুতে বসবাস করছে স্বজনহারা লোকজন।১৯৯১ সালের পর থেকে ধলঘাটা ইউনিয়নে বেড়ী বাঁধের বড় ধরনের সংস্কার হয়নি। স্থানীয় চিংড়ি চাষিরা জোড়া-তালি দিয়ে বেঁড়িবাঁধ সংস্কার করে বর্ষার সময় চিংড়ি চাষ করত। রোয়ানুর সময় সুতরিয়ার পশ্চিমে বেঁড়িবাঁধের বড় ধরনের ভাঙ্গন শুরু হয়ে বিলিন হয়ে যায় বেঁড়িবাঁধ। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর পর ইমারজেন্সি বরাদ্ধ দেওয়া হয় ৭কোটি টাকার। বর্তমানে ব্লক বসানোর জন্য ২১ কোটি টাকার বরাদ্ধের কাজ চলে। বেঁড়িবাঁধ সংস্কারের দায়িত্ব পাওয়া টিকাদারগণ মাটির পরিবর্তে বালি দিয়ে বেঁড়িবাঁধ সংস্কার করলে স্থানীয় চেয়ারম্যান কামরুল হাসান টেকসই কাজ করতে বলেন সংশ্লিষ্ট টিকাদারদের। টিকারগণ মাটির পরিবর্তে বালি কাজে লাগাতে না পেরে ,কাজ ফেলে চলেগেছে বলে জানান চেয়ারম্যান।

ধলঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান এ প্রতিবেদক কে জানান- অনেক দেনদরবার করে ধলঘাটা রক্ষার বেঁড়িবাঁধের বরাদ্ধ পেয়েছি। এই সময়ে দ্রুত বেঁড়িবাঁধ সংস্কার না হলে বর্ষার মৌসূমে প্রতি দিনের জোয়ারভাটায় লোকালয়ে পানি ডুকে বাড়ীঘর ডুবে যায়। বেঁড়িবাঁধ সংসকার হলে ধলঘাটা রক্ষা হবে। ধলঘাটা রক্ষা হলে মাতারবাড়ী ইউনিয়ন রক্ষা হবে। মাতারবাড়ী – ধলঘাটা রক্ষা হলে- মাতারবাড়ী কয়লা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র রক্ষা হবে; গড়ে উঠবে অর্থনৈতীক জোন সহ বড় বড় প্রকল্প।

২১ কোটি টাকার ব্লক বসানোর কথা ৭কি:মি: বেঁড়িবাঁধে। উন্নত মানের কনকর,বালি ও সিমেন্ট ব্যবহার না করে নি¤œমানের মালা-মাল দিয়ে ব্লক তৈরীর কাজে স্থানীয়রা বাঁধা দেয়। নি¤œমানের মালা-মাল দিয়ে ব্লক তৈরি করতে না পেরে টিকাদারগণ কাজ বন্ধ রাখে বলে জানান স্থানীয় চেয়ারম্যান কামরুল হাসান।

মহেশখালী উপজেলার নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আবুল কালাম- ১৯৯১সালের ২৯শে এপ্রিল তারিখে ঘূর্ণিঝড়ের সময় নিহতদের আত্তার মাগফেরাত কামনা করেন এবং মহেশখালী উপকূলে যে কোন দূর্যোগের সময় দরিদ্র জন-গোষ্টির দূর্যোগকালী সময়ে সহযোগিতা করতে উপজেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছেন। যে কোন দূর্যোগকে অবহেলা না করে; সিগন্যাল পাওয়ার সাথে সাথে প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়ার আহবান জানান।

ছবিক্যাপশন: ১৯৯১ সালের ২৯এপ্রিল প্রলয়ণকরী ঘুর্ণিঝড়ে বিলেঝিলে পড়ে থাকা মৃত মানুষের ফাইল ছবি। ধলঘাটা ইউনিয়নের স্বজন হারা সিরাজুল ইসলামের ছবি। বেঁড়িবাঁধের ঢালুতে ঝুপড়ি ঘর বেঁধে ঝুকি নিয়ে বসবাস এর ছবি।