মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী

লিগ্যাল এইড কি?
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পবিত্র সংবিধানে ২৭, ৩১ ও ৩৩ নং অনুচ্ছেদেও সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং ন্যায় বিচার ও সার্বজনীন মানবাধিকারের কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণে অস্বচ্ছল, সহায় সম্বলহীন ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ প্রায়ই আইনের আশ্রয় লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। একারণে আর্থিকভাবে অসামর্থবান নাগরিক, প্রতিবন্ধী, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা, এসিডদগ্ধ ও পাচারকৃত নারী পুরুষসহ নানাবিধ কারণে বিচার পেতে অক্ষম নাগরিকদের সম্পূর্ণ সরকারী অর্থ ব্যয়ে আইনী সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ২০০০ সালে সরকার “আইনগত সহায়তা প্রদান আইন” পাশ করে। এই আইনের মাধ্যমেই সরকার আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা অর্থাৎ ন্যাশনাল লিগ্যাল এইড কমিটি নামে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গঠন করে।
সংস্থার কর্মপরিধিঃ
সংস্থার অধীনে প্রত্যেক জেলায় জেলা ও দায়রা জজকে চেয়ারম্যান করে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি এবং প্রত্যেক উপজেলা ও ইউনিয়নে পৃথক পৃথক লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই সংস্থাকে একটি কার্যকর, গতিশীল , সেবামূলক ও দারিদ্রবান্ধব সংস্থায় পরিণত করার লক্ষ্যে সরকার প্রতি জেলায় একজন সিনিয়র সহকারী জজ মর্যাদার বিচারককে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার, প্রয়োজনীয় কর্মচারী নিয়োগসহ আনুসাঙ্গিক ভৌত অবকাঠামো সুবিধা দিয়ে অফিস স্থাপন করেছে। তাহাছাড়া বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগ, ঢাকায় শ্রম আদালত ও চৌকি আদালত সমূহেও লিগ্যাল এইডের পৃথক ইউনিটের মাধ্যমে এই সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি (এডিআর):
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা ২০১৫ সালে “আইনী পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি (এডিআর) বিধিমালা” প্রণয়ন করে। এ বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি কার্যক্রম দেশের আইনঙ্গনের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে “এডিআর কর্ণার” বা বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তির কেন্দ্রস্থল হিসেবে কাজে লাগিয়ে আদালত হতে প্রেরিত মামলা ও মামলা দায়েরের জন্য আনীত অভিযোগ জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের মধ্যস্থতায় এখন নিস্পত্তি করা হয়। এতে করে মামলায় উভয়পক্ষ বিচারের প্রক্রিয়াগত দীর্ঘ কার্যক্রমের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পায় এবং এই প্রক্রিয়া আদালতে মামলার জট হ্রাসে কিছুটা হলেও সহায়ক হচ্ছে। “বিরোধ হলে শুধু মামলা নয়, লিগ্যাল এইড অফিসে আপোষও হয়”-এস্লোগানটি এখন অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও শতভাগ সফল স্লোগানে পরিণত হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির কার্যক্রম:
জেলা লিগ্যাল এইড সংস্থার মাধ্যমে ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের ১৭২৯টি মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে। তার মধ্যে ১৯৬টি মামলা চুড়ান্তভাবে নিস্পত্তি করা হয়েছে। বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি (এডিআর) এর মাধ্যমে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১৪টি মামলা নেয়া হয়েছে এবং ৫৪টি মামলা এডিআর পদ্ধতিতে নিস্পত্তি করা হয়েছে। জেলা জজ আদালত ভবনে অবস্থিত জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে প্রতিমাসে অর্ধ শতাধিক মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিস্পত্তির জন্য গ্রহণ করা হয়। জেলা ও দায়রা জজ বাহাদুরের নেতৃত্বে গঠিত জেলা কমিটির মাধ্যমে প্রতিমাসে সমন্বয় সভা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও চৌকি আদালত এলাকায় সচেতনামূলক সভা, বিচারপ্রার্থীদের নিয়ে সভা ইত্যাদির মাধ্যমে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সেবাধর্মী ও দারিদ্রবান্ধব কার্যক্রম জেলায় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে এবং দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের মনে প্রচুর আশার সঞ্চার করেছে। জেলায় ৫৭ জন প্যানেল আইনজীবী জেলা লিগ্যাল এইড এর মামলা গুলোর নিয়োগ প্রাপ্ত কৌশুলী হিসেবে কাজ করছেন।
সামগ্রিকভাবে লিগ্যাল এইড কার্যক্রম যেন এক হতদরিদ্র অসহায় বিচার প্রার্থীদের জন্য আর্শিবাদ স্বরূপ। তাদের জন্য লিগ্যাল এইড সহায়তা যেন বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়া। এছাড়া এ কার্যক্রম সকল নাগরিকদের আইনের আশ্রয় লাভের মৌলিক ও সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছে। স্বচ্ছল ও প্রভাবশালী অপরাধীরা দরিদ্র ও অসহায় নাগরিকদের উপর অবিচার করে আইনের আওতায় না এসে পার পেয়ে যায়-এমন নেতিবাচক ধারনাও লিগ্যাল এইডের সুবাধে এখন পাল্টে গেছে।
লিগ্যাল এইড-এর সেবা ও ধারণা হতদরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে সরকার ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল-কে জাতীয় লিগ্যাল এইড দিবস ঘোষণা করেন। তখন থেকে ব্যাপক অনুষ্ঠানমালার মধ্যদিয়ে প্রতি বৎসর ২৮ এপ্রিল জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে লিগ্যাল এইড দিবস উৎসাহউদ্দীপনার মধ্যদিয়ে পালন করা হয়। এ বছরও ব্যাপক কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির উদ্যোগে জেলায় ৫ম জাতীয় লিগ্যাল এইড দিবস পালন করা হচ্ছে। লেখকঃ প্যানেল আইনজীবী, জেলা লিগ্যাল এইড্ কমিটি ও এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ঢাকা।