পলাশ বড়ুয়া:

পৃথিবীর রূপ, রং আর মায়ের কোলে ভুবন মাখা আদর স্নেহ পাওয়ার আগেই ছিটকে পড়ে জীবন যুদ্ধের চরম বাস্তবতার শিকার হচ্ছে শিশু আনোয়ার শাহাদাৎ।
তার ভাষ্যমতে ১২ বৎসর দাবী করলেও দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ৭/৮ বছরের বেশি হবে না। ৫ বৎসর পূর্বে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে স্বপরিবারে বাংলাদেশে চলে আসে। পিতার নাম ইয়াছিন আরফাত। পেশায় টিউবওয়েল মিস্ত্রী। রোহিঙ্গা শিবিরে ইউএনএইচসিআরের অধীনে কাজ করে।
তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় আনোয়ার । বর্তমানে সে কাজ করছে উখিয়া উপজেলার কোটবাজারস্থ কাঁচা তরকারি বাজারে আব্দু শুক্কুরের ঝাল বিতানে। বেতনও পায় ১ হাজার টাকা !
ঝালবিতানের পূর্বে একটি সবজি দোকানে কাজ করত বলে জানান আনোয়ার এবং ঝালবিতান মালিক আব্দু শুক্কুর। আনোয়ারের মতো ২ জন অবুঝ শিশুদের দিয়ে দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে শুক্কুর। জানতে চাইলে ক’দিন পরে নাকি সে চলে যাবে এমনটি জানান দোকান মালিক।
২৩ এপ্রিল (রবিবার) প্রিয় আলমগীর স্যার সহ সন্ধ্যায় ছোলা খেতে গেলে কর্মরত আনোয়ারকে দেখে ভেতরের মনুষ্য আত্মাটা কখন যে কেঁদে ফেলে নিজেও বুঝতে পারিনি। কথা গুলো বলছিলাম কারণ আমিও যে বাবা। আমার বড় ছেলে অদ্রি রাজ, বয়স ৫ বছর। ছোট ছেলে পূর্ণ রাজ বয়স ছয় মাস হলো। প্রতিদিন বাড়ি ফিরে সবার আগে অন্তত: আমার সন্তাদের ইচ্ছে মতো শুকে ঘ্রাণ নিই।
আনোয়ারের কোমল মুখায়বটি ক্যামেরায় ধারণ করতেই সে যেন আমার আশপাশেই ঘুরছিল। দ্রুত গ্লাস পরিষ্কার করে পানি নিয়ে আসল। যেখানে তার আন্তরিকতার পরিপূর্ণতা খুঁজে পেলাম। সেই সাথে পাশের টেবিলে বসা অন্যান্য কাষ্টমারদের সার্ভিস দিতেও দেরি করছে না। আনোয়ার তোমাকে কিছু দিতে পারিনি বলে নিজেকে খুবই অসহায় বোধ করছি আজ।
একই ধরণের দৃশ্য যখন রাস্তার পশ্চিমে চায়ের দোকানে মো: সেলিম (১৪)। সে জালিয়াপালং ইউনিয়নের পাটুয়ারটেক এলাকার মো: ইসলামের পুত্র বলে জানায়। এইসব শিশুদের ছবি তুলতেই দোকান মালিকদের চোখ রাঙানিও কিন্তু দেখার মতো ছিল।
ক্ষুধা, দারিদ্র, সংসারের অনটনের দায়ভার এসব শিশুদের কাঁধে চেপে বসেছে কিছু বুঝে উঠবার আগেই।
সরকারের সংবিধানে ১৮ বছরের নিচে প্রত্যেককে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ১৪ বছরের নিচে কাউকে কোনও সার্বক্ষণিক কাজে নিয়োগ না করাও বিধান রয়েছে। রং-বেরঙের পোশাকে পড়ে যখন মা বাবার হাত ধরে এসব শিশুরা স্কুলে কিম্বা বিনোদনে মেতে উঠতে চায়। দারিদ্রতা ওদের স্বপ্নকে ওই মুহূর্তে গ্রাস করে দেয়। দু-মুঠো পেটে ভাতের তাড়নায় শিশুগুলো ছিটকে বেরিয়ে এসেছে তার অভাব পুরণের জন্য। জীবন যখন যুদ্ধ।
আজকের শিশুরা নাকি আগামী দিনের কর্ণধার। শিশু আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে কিছু অসাধু শ্রেণির মানুষ। জানবার প্রয়োজন মনে হলো না বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় শিশু নীতি। ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের সার্বক্ষণিক শিশুশ্রমে নিয়োগ করা ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে শিশুদের জড়ানো বা ব্যবহার নিষিদ্ধ রয়েছে। আর এসব শিশুদের ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো হয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকের ন্যায় তাদের মালিকগণ কাজ আদায় করে নেন।
বেঁচে থাকার তাগিদে নানা কাজে জড়াচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। উখিয়ার চার পাশে ছড়িয়ে থাকা সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রমিক দেখা যায়। অভাবের তাড়নায় হোটেল, রেষ্টুরেন্ট, চটপটির দোকান, ইটভাটা, ওয়ার্কশপ, ফার্নিচার কারখানা, রিক্সা, বাস, ট্রাক শ্রমিক সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জীবনে ঝুঁকি নিয়ে কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দেশের প্রতিটি বিপনী কেন্দ্রেও দেখা যায় একজন করে শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিশু শ্রমিকের সংখ্যা-ই বেশি এসব প্রতিষ্ঠানে। নানা অমানবিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সর্বত্র শিশু শ্রমিকদের দেখা যায়।
অথচ ঠিকমত তাদের পারিশ্রমিকটাও দেয়া হয় না। এদের আবার অনেকেই অঙ্গহানি হয়ে পুঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। মাঝখান থেকে সরকার ও বিদেশী দাতা সংস্থা থেকে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের বিকাশে কাজ করার নামে নিজেদের পকেট ভারি করে নেয় অনেক এনজিও।
প্রশাসনের নজরে দিলে তো ভূতের মুখে রাম নাম তা প্রভাতেই আছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করা যাদের দায়িত্ব, তারা এসব তদারকি করছে কি ?। যে সকল কাজ শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তা বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং সঠিক প্রয়োগ করা হোক।
লেখক : সম্পাদক, সিএসবি ২৪ ডটকম। মোবাইল- ০১৮১৭৩৫০১৩৫