পরিবর্তন ডটকম:
এশিয়া মহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পরিবারতান্ত্রিক। বাংলাদেশের রাজনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই দেখা গেছে, এদেশের অধিকাংশ প্রতিথযশা রাজনৈতিক ব্যক্তি একে-অপরের আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ- তা নিজের দলের সদস্য কিংবা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সাথে হোক। এই আত্মীয়তার বন্ধন তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত।
এ কারণে এসব রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অনেককেই আবার সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। রাজনৈতিক মঞ্চে একে অন্যকে তুলোধুনা কিংবা বিষোদগার করলেও গোপনে তাদের মধ্যে সমঝোতা কিংবা আপোষকামীতার অভিযোগের তীর ছুড়তে দেখা যায় অধিকাংশ রাজনৈতিক বোদ্ধাদের।
যদিও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা মনে করেন, রাজনৈতিক আদর্শ এক। আর সামাজিক বন্ধন আরেকটি বিষয়। এই দুইটি বিষয়কে একত্রে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে গোপনে সমঝোতা কিংবা আপোস করার প্রশ্নই উঠে না।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ও সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর বিয়েকে কেন্দ্র করে রাজনীতিবিদের আত্মীয়তার বিষয়টি আবারো আলোচনা উঠে এসেছে।
আগামী ২১ আগস্ট শুক্রবার জিয়াউদ্দিন বাবলু দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে যাচ্ছেন সংসদ সদস্য মেরিনা ইয়াসমিনের মেয়ে এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাগ্নি মেহেরুজেবুনেছাকে। এর ফেলে জিয়াউদ্দিন বাবলুর শাশুড়ি হচ্ছেন সংসদ সদস্য মেরিনা ইয়াসমিন ও মামা শ্বশুর হচ্ছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তার স্বামী খন্দকার মাশরুর হোসেন মিতু। তিনি বর্তমান সরকারের এলজিআরডি মন্ত্রী এবং ফরিদপুর-৩ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে। ফলে শেখ হাসিনা ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ সম্পর্কে বেয়াই-বেয়াইন।
মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী প্রয়াত আইভী রহমান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার খালা শাশুড়ী। সে হিসেবে জিল্লুর রহমান ছিলেন শেখ হাসিনার তালই। আবার জিল্লুর রহমান ও আইভী রহমানের সন্তান হলেন ভৈরব-কুলিয়ারচর আসনের আওয়ামী লীগের এমপি ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বোন আছিয়া বেগমের দুই ছেলে হলেন শেখ ফজলুল হক মণি ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সম্পর্কে তারা শেখ হাসিনার আপন ফুফাতো ভাই। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণির ছেলে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য। বঙ্গবন্ধুর আরেক ভাগ্নে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিম হলেন সাবেক মন্ত্রী ও গোপালগঞ্জ-২ আসনের এমপি।
শেখ সেলিমের বোনের স্বামী হলেন বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা ও এরশাদ সরকারের সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জুর। যিনি পরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যোগ দেন। মঞ্জুর সম্পর্কে শেখ হাসিনার ফুফাতো বোনের স্বামী। আবার মঞ্জুরের দুই ছেলে বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ ও ডা. আশিকুর রহমান শান্ত। বর্তমানে তারা বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়। শেখ হাসিনা সম্পর্কে তাদের খালা। আবার শেখ সেলিমের ছেলে বিয়ে করেছেন বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর মেয়েকে। ইকবাল হাসান টুকু ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠি ছিলেন।
শেখ সেলিমের আরেক ছেলে বিয়ে করেছেন আলোচিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের মেয়েকে। এই মুসা বিন শমসেরের ছেলে ববি হাজ্জাজ হলেন এরশাদের সাবেক মুখপাত্র ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা।
বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের। তার ছেলে হলেন বাগেরহাট-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ হেলাল। তার মেয়ের জামাই হলেন ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। শেখ সেলিম ব্যারিস্টার পার্থের মামা ও শেখ হেলাল পার্থের শ্বশুর। আবার শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ মণি ও শেখ সেলিমের আরেক ছোট বোনের জামাই হলেন যুবলীগের বর্তমান সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী। আর শেখ সেলিমের ভায়রা হলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী জামালপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। শেখ হাসিনা ও হাসানাত আবদুল্লাহ পরস্পরের মামাতো-ফুফাতো ভাই-বোন। আবার হাসানাত আবদুল্লাহর ছোটবোনের দেবর হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি সম্পর্কে শেখ হাসিনার বেয়াই। হাসানাত আবদুল্লাহর সম্পর্কে চাচাতো ভাই হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক।
শেখ হাসিনার চাচা সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লি. এর চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেনের বেয়াই ছিলেন বিএনপির দীর্ঘ সময়ের মহাসচিব এবং ১/১১’র সংস্কারপন্থি শীর্ষ নেতা প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। মান্নান ভূঁইয়ার ছেলের সঙ্গে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় শেখ কবিরের মেয়ের। সেই হিসেবে শেখ হাসিনার সম্পর্কে তালই ছিলেন মান্নান ভূঁইয়া।
এছাড়া শেখ হাসিনার সম্পর্কে ফুফা হলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, মন্ত্রী ও ঝালকাঠি-২ আসনের সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমু। তার স্ত্রী প্রয়াত ফিরোজা হোসেন সম্পর্কে শেখ হাসিনার ফুফু।
শেখ হাসিনার দূর সম্পর্কের ফুফা ছিলেন লে. জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান বীরবিক্রম। পুরানো সম্পর্কে মোস্তাফিজুর রহমান ও খালেদা জিয়া পরস্পরের দূরসম্পর্কীয় খালাতো ভাই-বোন।
জিয়া পরিবারের দুই সন্তান তারেক রহমান ও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো। তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। তারেক রহমানের শ্বশুর হলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান মাহবুব আলী খান। তিনি ছিলেন ‘জাগদল’ সদস্য ও জিয়া সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী।
তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের খালু হলেন ফরিদপুরের বিখ্যাত খন্দকার পরিবারের সন্তান হিরু মিয়া। আর হিরু মিয়া হলেন বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের চাচাতো দাদা শ্বশুর।
বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার স্ত্রী সিগমা হুদার বড় ভাই দারা কবির বিয়ে করেছেন জিয়াউর রহমানের খালাতো বোন আতিকা শিরিনকে।
বিকল্পধারার সভাপতি প্রফেসর ডা. এ কিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তার বাবা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী কফিলউদ্দিন চৌধুরী। বদরুদ্দোজা রাজনীতিতে আসেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে।
বিএনপির প্রথম মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করেন প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। বি. চৌধুরীর ছেলে হলেন বিএনপি সরকারের সাবেক এমপি ও বর্তমানে বিকল্পধারার সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী। বি. চৌধুরীর শ্যালিকা হলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য পান্না কায়সার।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার আপন ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদের জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী। এরশাদের আরেক ভাই প্রয়াত মোজাম্মেল হোসেন লালু ছিলেন জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি। এরশাদের ভাতিজা হলেন রংপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ।
এরশাদের বোন মেরিনা রহমান সাবেক এমপি এবং ভগ্নিপতি প্রয়াত ড. আসাদুর রহমান রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। আবার এরশাদের সম্পর্কে মামা ছিলেন বঙ্গবন্ধু, জিয়া ও এরশাদ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া। সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের সহধর্মিণী রওশন এরশাদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১০ম সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী। তিনি ময়মনসিংহ সদর ও গাইবান্ধা থেকে একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
রাজনীতিতে আত্মীয়করণের বিষয় থাকলে নেতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলে কি না এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. নজরুল ইসলাম খান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘পরিবারিক সম্পর্ক রাজনীতিতে কিছু প্রভাব ফেলে না তা নয়। কিছু প্রভাব ফেলে। কিন্তু যারা সঠিক ধারার রাজনীতি করেন তারা কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে রাজনীতিকেই মূল মাপকাঠি হিসেবে ধরেন। আমার আত্মীয়র মধ্যে কেউ থাকতে পরে অন্য দলের। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসে আমাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।’
‘যেখানে প্রভাব বিস্তার করে সেখানে আত্মীয়করণের বিষয়টি আসে। তখন সেটা বেশ ক্ষতির বিষয় হয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে যারা সঠিক রাজনীতি করবে তাদের আত্মীয় বন্ধু কোনো কিছুই তার রাজনীতিক আদর্শ হওয়া উচিত না’- যোগ করেন নজরুল ইসলাম খান।
এ প্রসঙ্গে জানাতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, রাজনীতিতে আত্মীয়করণের বিষয়টি শুধু তো আওয়ামী লীগে তা তো নয়। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলেই আছে। তবে কোনো দলে কম কোনো দলে বেশি। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন রাজনৈতিক দল। তাই হয়তো এই বিষয়টা কিছুটা বেশি। এখানে তো আমি সমস্যার কোনো কারণ দেখছি না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো আত্মীয়তাকে বাইরে রেখে রাজনৈতিকভাবে নিলেই তো কোনো সমস্যা থাকে না।
এ ব্যাপারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আত্মীয়করণ তো অনেক আগের। এটা দিন দিন আরো বাড়ছে। তবে রাজনীতির ইতিহাসে অতিরিক্ত আত্মীয়করণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলে না। আত্মীয়করণের কারণে যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে রাজনীতিতে অযোগ্য লোক প্রবেশের সম্ভাবনা থাকে। এটা অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।