শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার, ১৮ এপ্রিল ॥

অভাবের তাড়নায় ঝরেপড়া মাঈন উদ্দীন মানিকের পড়া লেখার দায়িত্ব নিয়েছে কক্সবাজার ছাত্রলীগ। মানিক এখন আবার পড়ালেখা করবে, কাধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাবে। তার আশা পূরণ হবে। সেই লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবে। ১৮ এপ্রিল ‘মানিক পড়তে চাই,’ঝড়ে পড়া স্কুল শিশু মানিক সর্বকনিষ্ঠ গ্রাম পুলিশ’ শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস পোষ্ট করার পর বদলে দিয়েছে মানিকের জীবন।

দুই ভাইয়ের মধ্যে মানিক বড়। পুরো নাম মাঈন উদ্দীন মানিক। একমাত্র আদুরে ছোট ভাই বাবুল। মা ও ছোট ভাইয়ের দু’বেলা আহার জোগাড় করতে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে ১৪ বছরের শিশু মানিক। এই মানিক এখন গ্রাম পুলিশের পোশাক পরেই অনিয়মিত চাকরি করছে কক্সবাজারের পেকুয়া থানায়। ১১ বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বাবা দফাদার (গ্রাম পুলিশ প্রধান) আকরম মিয়া চলে যান না ফেরার দেশে। উত্তরাধিকারীর জন্য বাবা শুধু রেখে গেছেন গ্রাম পুলিশে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের মাত্র একজোড়া পোশাক। এই পোশাকই তার একমাত্র সম্বল। মায়ের বোঝা না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই এখন চাকরি বেছে নিয়েছে মানিক। থানার স্যারদের (এসআই, এএসআই ও কনস্টেবল) চা, নাস্তা, পানি ও হালকা কাজগুলো করাটা ঝক্কি-ঝামেলার হলেও এটাকে খুব উপভোগ করছে শিশু মানিক। মা ও ছোট ভাইয়ের দু’বেলা আহার জোগাতে প্রতিদিন নিরলসভাবে মানিক চা-পান ইত্যাদি এনে দিচ্ছে থানায় দায়িত্বরতদের। পুলিশরাও তাকে খুব স্নেহ করে। মানিক বলে ডাক দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজির।

কক্সবাজারের পেকুয়া উজানটিয়া ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড সুতাচুরা ঠান্ডাপাড়া গ্রামে বসবাস মানিকদের। বাবা আকরাম মিয়া ইউনিয়নের দফাদার (গ্রাম পুলিশ) পেশায় দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। আকবর আলী প্রকাশ আকরাম দফাদারের ছিল এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি। বিশ্বস্ত ছিলেন বলে থানা পুলিশও তাকে বেশ ভালো চোখে দেখতেন। তার তিন ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে মাসে মাত্র ৩ হাজার টাকা বেতনে সংসার খুব সুখেই চলছিল। কিন্তু সেই সুখ তাদের সংসারে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় গত ১১ বছর আগে মারা যান আকবর আলী প্রকাশ আকরাম মিয়া দফাদার। বাবার মৃত্যুর কয়েক বছর পর মারা যান মানিকের আরেক ভাই। পিতৃহীন দু’ছেলে মাঈন উদ্দীন ও বাবুলকে নিয়ে মা মুশারমা বেগম এখন বড়ই অসহায়।

গ্রাম পুলিশ বাবা আকবর আলীর মৃত্যুর পর বাবার পোষাক পড়ে নিজেকে গ্রাম পুলিশ পরিচয় দিতে পছন্দ করে মানিক । বাবার স্মৃতি নাকি খুব মনে পড়ে তাই বাবার খাকি পোষাক পড়ে ঘুরে বেড়ানো । ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত পড়া মানিক দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়।

মানিক জানান, বাবার মৃত্যুর পর গ্রাম পুলিশের চাকরিটা পুষ্য কোটায় করতে চাইলাম, মা ও কাজ পেলো না ইউপি চেয়ারম্যান থেকে ।

চোখে মুখে বিষণœতার ছাপ। মানিক শোনালো তার ট্রাজেডিপূর্ণ জীবনের গল্প। সে নিজে কোনদিন স্কুলে যায়নি। গরীব বলে বাবার মৃত্যুর পর ছোটভাই বাবুলেরও সে সুযোগ হয়নি। পরিবার থেকে পড়াশুনার খরচাদি না পাওয়ায় বেকারত্ব জীবন ভালো লাগে না মানিকের। বাবার মৃত্যুর পর কাফনের কাপড় কেনার টাকা না থাকার কথা প্রতিবেশীদের মুখ থেকে শুনেছে মানিক। চাঁদা উত্তোলন করে কাফনের কাপড় কিনে গ্রাম পুলিশ বাবাকে দাফন করা হয়েছিল ওইসময়।

মানিক জানান, সারাজীবন তার বাবা গ্রাম এবং গ্রামের মানুষকে পাহারা দিয়েছেন। কিন্তু দু’বেলা দু’মুঠো ভাত ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। সহায় সম্বল বলতেও কিছুই রেখে যেতে পারেননি। এরপরেও শিশু মানিকের অনেক আগ্রহ, বাবার মতোই সে গ্রাম পুলিশ হবে।

মানিক জানায়, বাবা নেই, এখন মাও অসুস্থ। বয়স না হওয়ায় তার চাকরিও হয়নি। এখন শুধু তার দাবি অন্তত মরহুম বাবার পদে তার মা’কে নিয়োগ দেয়া হোক। লেখাপড়ার অধীর আগ্রহ থাকার পরেও আর্থিক অভাবে তা হচ্ছে না মানিকের। বয়স মাত্র ১৪ বছর। চাকরির বয়স হয়নি, এরপরেও মায়ের বোঝা হয়ে থাকতে পছন্দ নয় বিধায় শিশু মানিক পেকুয়া থানায় স্যারদের হালকা কাজগুলো করছে।

মানিক আরো জানায়, ‘আমাদের ছোট পরিবার, মা এবং ছোট ভাই দু’জনই অন্যের বাড়িতে কাজ করে। মাও বর্তমানে অসুস্থ। তারপরও আমার বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে না। শিশু বয়সে থানায় চাকরিটা অনেক কষ্টের হলেও দুঃখ নেই উল্লেখ করে শিশু মানিক জানায়, ‘যখন আমি স্যারদের কাছে চাকরি করছি- সবাই আমাকে ¯েœহ করেন। অস্থায়ী চাকরি পেয়ে এখনও আনন্দ করছি। যখন ভালো লাগবে না তখন ছেড়ে দিব। সবাই আমাকে অনেক আদর এবং করুণা করে টাকা-পয়সাও দেন। পড়ালেখা করতে খুব ইচ্ছে জাগে।

অভাবের ঘরে জন্ম নেয়া মানিকের মা গৃহিনী,পরিবারের কারো কোনো কাজ নাই এখন আবার মায়ের খুব অসুখ । মায়ের উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন পত্র নিয়ে ১৮ এপ্রিল দুপুরে ঘুরাঘুরি করে আদালত প্রাঙ্গনে ।

১৮ এপ্রিল কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ঈসমাইল সাজ্জাদ তার ফেইজ বুক ওয়ালে ‘মানিক পড়তে চাই,’ঝড়ে পড়া স্কুল শিশু মানিক সর্বকনিষ্ঠ গ্রাম পুলিশ’ শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস পোষ্ট করার পর বদলে দিয়েছে মানিকের জীবন।

কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ জয় বলেন, ফেইজবুকে স্ট্যাটাস পেয়ে আমি মানিকের খোঁজখবর নিয়েছি। তার ট্রাজেটিপূর্ণ জীবন কাহিনী আমার হৃদয়ে দাগ কেটেছে।

তিনি বলেন, অভাবের কারনে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশু দেশের সর্ব কনিষ্ঠ গ্রাম পুলিশ মানিকের পড়ালেখার দায়িত্ব আমরা কক্সবাজার ছাত্রলীগ পরিবার নিলাম। পাশাপাশি ধন্যবাদ জানান তার প্রিয় সহযোদ্ধা সাজ্জাদকে।

মানিক জানান, এখন আমি আবার পড়ালেখা করবো, কাধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাবো। আমার আশা পূরণ হবে। আমি লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবো।